চল নিজের চোখে দেখবে।
দাঁড়াও,-এই বলে টেবিলের উপরে রক্ষিত মোমবাতিটা নিয়ে পাশের ঘরের দিকে রওনা হল কেরী, পিছনে ডরোথি। ঘরটার দরজার কাছে গিয়েই কেরী হো হো করে হেসে উঠল, বলল, ঐ দেখ, তোমার ভ্যাম্পায়ার আলোর জাদুতে কাঠের পায়। পরিণত হয়ে গিয়েছে!
ভুল ভাঙতে ডরোথির বিলম্ব হল না। যদিচ ‘পাঙ্খা’ পদার্থটির সঙ্গে কেবল আজই সন্ধ্যায় তার পরিচয়, তবু ও বস্তৃটা যে পাখা ছাড়া আর কিছু নয়, অনিদ্রা পাখা পুলারের টানে নড়ছে, এ সত্য তাকেও স্বীকার করতে হল। তখন তার এতক্ষণের উপটীয়মান সমস্ত ক্রোধ এসে পড়ল স্বামীর উপর।
ব্রহ্মাস্ত্রের সঙ্গে স্ত্রীজাতির ক্রোধের তফাৎ ঐখানে। নিক্ষিপ্ত ব্ৰহ্মাস্ত্র স্বর্গ মর্ত্য রসাতল খুঁজে লক্ষ্য না পেলে, ফিরে এসে আঘাত করে অস্ত্রীকে, আর স্ত্রীজাতির লক্ষ্যভ্রষ্ট ক্রোধ এসে পড়ে স্বামীর ঘাড়ে। কিন্তু সত্যই তফাৎ আছে কি? স্বামী-স্ত্রী যে অভিন্ন সত্তা। অভিন্ন সত্তা বটে, কিন্তু ভিন্নমুখ, পত্নী চন্দ্রের চিরোজ্জ্বল মুখ, স্বামীর মুখটা চিরন্তন নিষ্প্রভ।
ডরোথি শয্যায় এসে বসে পড়ল আর সঙ্গে সঙ্গে ক্রোধের বাষ্প প্রভূত অশুতে ঝরতে শুরু হল–
আমার এমনই কপাল যে তোমার মত লোকের হাতে পড়েছিলাম, নইলে এমন দেশে কেউ আসে যেখানে ঘরের পাশে বাঘ ডাকে আর ঘরের মধ্যে ভ্যাম্পায়ার উড়ে বেড়ায়!
কিন্তু ডিয়ার, স্বচক্ষে তো দেখলে ওটা ভ্যাম্পায়ার নয়, ‘পাঙ্খা’!
কিন্তু ধর যদি ভ্যাম্পায়ার হত?
ভ্যাম্পায়ার বলে কিছু নেই।
আমি বলছি অবশ্যই আছে। অপরিচিত দেশের সব রহস্য কি তুমি জান? আর তাছাড়া যে দেশে বাঘের ডাকে ঘুম ভেঙে যায়, সে দেশে জানপ্রাণ কতক্ষণ নিরাপদ? আচ্ছা, ভ্যাম্পায়ার না থাকুক, বাঘ তো আছে!
কে অস্বীকার করছে?
পারলে করতে, বলতে যে শেয়াল ডাকছে।
সে কথা মিথ্যা নয়, শেয়াল আর বাঘ কাছাকাছি থাকে।
তবে?
যেন ঐ ‘তবে’ বলাতে ডরোথির জয় হল, যেন তর্কটার ওখানে চূড়ান্ত হয়ে গেল। তাই সে এবারে প্রসঙ্গ উল্টে বলল—আগামী মেলেই ছেলেদের আর কেটিকে নিয়ে আমি দেশে চলে যাব, এ হিদেনের দেশে এক দঙ থাকব না।
কিন্তু ডিয়ার, ভুলে গেলে কেন যে হিদেনদের সত্যধর্মে দীক্ষিত করবার উদ্দেশ্যেই আমরা এখানে এসেছি!
‘আমরা’ নয়, বল ‘আমি’ এসেছি। তুমি সত্যধর্মে দীক্ষা দাও, আমরা ফিরে যাব।
আগে আপত্তি করলে না হয় না আসতাম, কিন্তু এখন তো।
কেরীর বাক্য শেষ হবার আগেই ডরোথি চীৎকার করে উঠল—একশ বার আপত্তি করেছিলাম। তখন আমাকে হাত করতে না পেরে ফেলিক্স, পিটার আর কেটিকে হাত করে নিয়েই তো আসতে বাধ্য করলে।
কেরী মৃদু হেসে বলল, এখন যদি তারা যেতে রাজী না হয় তবে কি করবে?
আমি একাই যাব জ্যাভেজকে নিয়ে। যাক ওরা বাঘের পেটে।
এই বলে আবার সে চোখের ধারা ছেড়ে দিল, কাদতে লাগল ফুপিয়ে ফুপিয়ে।
কেরী বুঝল এমন আর কিছুক্ষণ চললে ডরোথির হিস্টিরিয়া রোগটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে, আর হিস্টিরিয়ার আক্রমণ একবার শুরু হয়ে গেলে বাড়িসুদ্ধ সবাইকে তুলবে অস্থির করে। নূতন জায়গায় প্রথম রাতেই সেটা হবে লজ্জার চরম।
তখন সে নরম হয়ে বলল, ডরোথি ডিয়ার, এখন ঘুমোও, ফেরবার কথা ভেবে দেখব। তুমি যা বললে তার মধ্যে অনেক সার কথা, ভাববার কথা আছে।
স্নেহময় বাক্যে ডরোথির মন অনেকটা নরম হল। ঝড় থামল কিন্তু ঝড়ের দোলা থামতে চায় না। সে শুয়ে পড়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল এবং কখন একসময় নিজের অজ্ঞাতসারে ঘুমিয়ে পড়ল।
কেরী পত্নীকে, ভাল ভাবেই চিনত, জানত যে তার চিন্তায় ও কাজে দৃঢ়তা বলে কিছু নেই, সমস্ত বিষয়েই শেষ পর্যন্ত সে স্বামীর উপর নির্ভরশীল। তবে মাঝে মাঝে ঝোঁকের মাথায় ও হিস্টিরিয়ার প্রকোপে এক-একটা সঙ্কট সৃষ্টি করে বসা ডরোথির স্বভাব, কোন রকমে সেটা কাটিয়ে দিতে পারলেই আবার সে এসে পড়ে স্বামীর মুঠোর মধ্যে। কেরী বুঝল দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার অস্বাভাবিক জীবনের প্রতিক্রিয়ায় আজ রাত্রে দেখা দিয়েছিল এইরকম একটা সঙ্কট—তবে সেটা বড় রকম অনর্থ ঘটাবার আগেই গেল কেটে। পত্নীর কাছে তর্কের বেলায় হেরে কাজের বেলায় জেতে যে স্বামী তাকেই বলি বুদ্ধিমান।
.
১.০৫ কলিকাতা দর্শন
ব্রেকফাস্টের পর সকলে ড্রইংরুমে অপেক্ষা করছে এমন সময় রামরাম বসু ও পার্বতী ব্রাহ্মণ এসে পৌঁছল।
কেরী বলল, মিঃ মুন্সী, তোমাদের জন্যেই আমরা অপেক্ষা করছিলাম, চল শহর দেখতে বের হব।
রামরাম বসু বলল, চলুন, আমরা তৈরি।
গাড়িবারান্দায় দুখানা বুহাম অপেক্ষা করছিল। প্রথমখানায় উঠল কেরী, কেরী পত্নী, ডাঃ টমাস, রামরাম বসু ও পার্বতী ব্রাহ্মণ। দ্বিতীয়খানায় উঠল মিস প্ল্যাকেট, মিস স্মিথ, ফেলিক্স কেরী ও জন স্মিথ। পিটার ও জ্যাভেজ বাড়িতেই রইল।
প্রথমে এলিজাবেথ যেতে চায় নি, কিন্তু ক্যাথারিন কিছুতে ছাড়ল না, অগত্যা সে রাজী হল।
কেটি বলল, যাবে না কেন? তুমি সঙ্গে থাকলে বেশ কথাবার্তা বলা যাবে।
লিজা বলল, তাতে জন বোধ হয় খুশি হবে না, কি বল জন?
জন বলল, সে কি কথা! তিনজন না হলে কি আলাপ জমে?
লিজা বলল, আলাপ নানা রকমের।
যেমন?
এই ধর, প্রেমালাপ!
ইউ নটি গার্ল!
কথাটা কেটি শুনতে পায় নি, শুধাল, মিঃ স্মিথ কি বলছে?