দেখা যাক। সত্যি কাল যাবে তো?
সত্যি নিয়ে গেলে সত্যি যাব।
তার পর কেটি আপন মনে গুনগুন করে গান শুরু করল–
Under the Greenwood tree
Who loves to lie with me…
সে বিষয়ে কি তোমার সন্দেহ আছে, কেটি?
এমন সময়ে অদূরে একসঙ্গে কতকগুলো বন্দুকের আওয়াজ হল। কেটি শুধাল, ও কি!
বন্দুকের আওয়াজ, নেটিভ পাড়ায় ডাকাত তাড়াচ্ছে।
ডাকাতও আছে নাকি? তবে তো শেরউড ফরেস্ট হয়ে উঠল!
উঠলই তো। এমন কি, রবিনহুড ও মেড মারিয়ানেরও অভাব হবে না।
মিসেস কেরী শুধাল, ডাঃ টমাস, ও কিসের শব্দ?
টমাস বুঝেছিল যে ডাকাত বললে মিসেস কেরী এখনই হাউমাউ করে উঠবে, তাই সে বলল, ও কিছু নয়। নেটিভ পাডায় উৎসব হচ্ছে, তারই ঘটা।
গাড়ি মোড় বেঁকে বেরিয়াল গ্রাউণ্ড রোডে ঢুকল এবং কিছুক্ষণ পরেই জর্জ স্মিথের ফটকওয়ালা বাড়ির প্রকাণ্ড হাতার মধ্যে প্রবেশ কবল।
জর্জ স্মিথ মান্য অতিথিদের অভ্যর্থনার আয়োজনের ত্রুটি করে নি। রোশনাই এর ব্যবস্থা হয়েছে দরাজ হাতে। বাড়ির গাড়িবারান্দার কাছে দুদিকে সারিবদ্ধ শতাধিক দাসদাসী। খানসামা, সরকার, খিদমতগার, সর্দারবেয়ারা, বাবুর্চি, আবদার, আয়া, দারোযান, সহিস, মালী, মেথর, মেথরানী, ভিস্তি, চাপরাসী, ধোবি, দরজি, চোপদার, হুঁকাবদার প্রভৃতি ধোপদুরস্ত পোশাকে সসম্ভ্রমে দণ্ডায়মান। বারান্দার উপরে বৃদ্ধ জর্জ স্মিথ ও কন্যা মিস এলিজাবেথ স্মিথ। জর্জ স্মিথ বিপত্নীক।
গাড়ি থামবামাত্র শতাধিক দাসদাসী আভৃমি নত হয়ে সেলাম করল। জর্জ কেরীকে হাত ধরে নামাল, এলিজাবেথ মিসেস কেরীকে নামাল। দ্বিতীয় গাড়ির আরোহীরা নামলে সকলে মিলে ড্রইংরুমে প্রবেশ করল।
রামরাম বসু কলকাতার শ্বেতাঙ্গসমাজের রীতিনীতির সঙ্গে পরিচিত। সে জানে তার মত লোকের অধিকার ঘাট থেকে ঘর পর্যন্ত, ঘরের মধ্যে নয়। সে কেরীকে বলল, ডাঃ কেরী, আমি এখন চললাম, কাল সকালে আসব।
কেরী বলল, মিঃ মুন্সী, অবশ্য আসবে।
অতিথির নিমন্ত্রিত ব্যক্তির প্রতি ভদ্রতা করা উচিত মনে করে জর্জ বলল, মিঃ মুন্সী, অবশ্য আসবে। এরা কাল সকালে যখন নগর-ভ্রমণে বেরোবে তখন তোমাকে সঙ্গে থাকতে হবে। এ নগৰ সম্বন্ধে তোমার মত ওয়াকিবহাল আমরা নই।
রাম বসু উভয়কে সেলাম করে প্রস্থান করল।
.
‘সাপার’ শেষ করে শুতে যাওয়ার আগে জনকে একান্তে পেয়ে এলিজাবেথ বলল কি জন, ঘাটে না গেলে ঠকতে মনে হচ্ছে!
জন বলল, আমারও তাই মনে হচ্ছে।
দেখলে তো, শিকার কেবল বনেই মেলে না!
না, নদীতেও মেলে।
এটি কি? গোল্ড ফিশ না মারমেড?
ও দুয়ের কিছুই নয়। এটি হচ্ছে মেড মারিয়ান।
ইতিমধ্যে নামকরণও হয়ে গিয়েছে—ইউ লাকি ডগ!
দুই ভাইবোন হেসে উঠল।
যৌবনে হাসির ঢেউ অকারণে আসে, অযাচিতভাবে আসে, বার্ধক্যে এক-আধটা ঢেউ-এরও দেখা মেলে না কেন? যৌবন বহির্মুখী, বার্ধক্য অন্তর্মুখী-তাই কি?
.
১.০৪ ওটা কি সত্যকার বাঘ?
অনেক রাতে ঠেলা খেয়ে কেরী সাহেব জেগে উঠল, দেখল যে পত্নী পাশে দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঁপছে।
কেরী শুধাল, ডরোথি, কি হয়েছে?
ডরোথি নীরব, দেহ ভয়ে কম্পমান।
হঠাৎ অসুখ-বিসুখ হয়েছে আশঙ্কায় কেরী উঠে দাঁড়িয়ে পত্নীকে চৌকির উপরে বসাল, জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে বল তো?
কি হয়েছে! শুনতে পাচ্ছ না?—এতক্ষণে ডরোথির বাকস্ফূর্তি হল।
কি শুনব?
ঐ যে বাইরে গর্জন, কি যে ডাকছে।
এবারে কেরী সত্যই শুনতে পেল, বাইরে কোন একটা জন্তুর গর্জন।
ভীত ডরোথি ফিস ফিস স্বরে শুধাল, ওটা কি ডাকে?
কেরী বলল, বাঘের ডাক তো স্বকর্ণে কখনও শুনি নি, তবু যতদূর বুঝতে পারছি বাঘের ডাক বলেই মনে হচ্ছে, জলে দেশ কিনা।
ওটা কি সত্যিকার বাঘ? শুধাল মৃতপ্রায় পত্নী।
কেরী হেসে বলল, ডিয়ার, সত্যি বাঘ ছাড়া এত রাতে আর কি ডাকবে!
যদি আক্রমণ করে?
সামনে পেলে আক্রমণ করে বই কি।
কি সর্বনাশ! তাতে আবার জানালাগুলো সব খোলা!
এই বলে ডরোথি গরাদহীন বড় বড় খোলা জানালাগুলোর দিকে তাকাল।
বাঘ লোকালয়ে কখনও আসে না।
কেমন করে জানলে? তুমি কি বাঘ দেখেছ কখনও? তবে? আমি বই-এ পড়েছি যে, বাঘ পশুর মধ্যে সবচেয়ে হিংস্র। তার হাতে পড়লে আর নিস্তার নেই।
কিন্তু তার হাতে পড়বে কেন?
পড়তে বাধাই বা কি? যেখানে ঘরের পাশে বন, বনের মধ্যে বাঘ! বন তো ঘরের পাশে নয়।
অবশ্যই পাশে। কেটি বলছিল যে, পাশেই প্রকাণ্ড বন, কাল সেখানে বেড়াতে যাবে!
ডরোথি, তুমি মিছে ভয় পাচ্ছ, তেমন বাঘের ভয় হলে এখানে মানুষ থাকতে পারত না। নাও, তুমি এখন ঘুমোও।
পাশের ঘরে ছেলেরা ঘুমোচ্ছ, তাদের একবার দেখে আসি-বলল ডরোথি।
যাও, কিন্তু জাগিও না।
পাশের ঘরটিতে ফেলিক্স, পিটার, জ্যাভেজ ও ক্যাথারিনের শয়নের ব্যবস্থা হয়েছিল। ডরোথি সেই ঘরের দিকে গেল।
এক মুহূর্ত পরে উধ্বশ্বাসে ফিরে এল ডরোথি।
সর্বনাশ বিল, সর্বনাশ!
আবার কি হল? বলল উদ্বিগ্ন কেরী।
ঘরের মধ্যে প্রকাণ্ড একটা ভ্যাম্পায়ার।
ভ্যাম্পায়ার! অবিশ্বাস ও পরিহাসের মাঝামাঝি স্বরে বলল কেরী। ভ্যাম্পায়ার বলে কোন প্রাণী নেই। তা ছাড়া ও ঘরটা অন্ধকার, কি দেখতে কি দেখেছ!
রাগে দুঃখে জ্বলে উঠে পত্নী বলল, কি দেখতে কি দেখেছি। স্পষ্ট দেখেছি মস্ত পাখাওয়ালা কিস্তৃত পাখী ছেলেদের ঠিক মাথার উপরে নড়ছে।
বল কি! এবারে কেরীর স্বরে বিশ্বাসের আভাস লেগেছে।