কেরী বলল, শেয়ালের।
শেয়াল? তুমি কি বলতে চাও সত্যিকার শেয়াল? তুমি নিশ্চিত জান ওগুলো নেকড়ে নয়?
কেরী হেসে বলল, অত্যন্ত নিশ্চিত। কেরী-পত্নীকে নিশ্চিন্ত করবার উদ্দেশ্যে টমাস বলল, ওগুলো খুব নিরীহ জানোয়ার। কত দেখতে পাবে বেরিয়াল গ্রাউন্ড রোডে।
হোয়াট, কোথায়?
টমাস বলল, যেখানে আমরা তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি, বেরিয়াল গ্রাউন্ড—
তার বাক্য সমাপ্ত হবার আগেই ডরোথি চাপা তর্জন করে উঠল, বলল, বিল, তোমার মনে শেষে এই ছিল? বিদেশে এনে আমাকে বেরিয়াল গ্রাউন্ডে নিয়ে চলেছ?
ডিয়ার, তুমি ব্রাদার টমাসের বাক্য পুরোপুরি না শুনে ভয় পাচ্ছ—বেরিয়াল গ্রাউণ্ড নয়, বেরিয়াল গ্রাউণ্ড রোড, একটা রাস্তার নাম!
টমাস বলল, সেখানে বহু ধনী লোকের বাস, অবশ্য কাছেই একটা বেরিয়াল গ্রাউন্ড আছে বটে।
তাই বল, তারা সব শয়তানের প্রতিবেশী—এই বলে ডরোথি নিতান্ত অপ্রসন্ন মুখে শালখানা গায়ের উপর টেনে নিয়ে চুপ করে রইল।
পত্নীর ব্যবহারে লজ্জিত কেরী কথার মোড় ঘোরাবার আশায় রাম বসুকে জিজ্ঞাসা করল, মিঃ মুন্সী, এই মশালগুলো বুঝি পথ আলো করবার জন্যেই?
ঠিক ধরেছ ডাঃ কেরী।
জঙ্গলের ভিতর দিয়ে ঐ যে ওদিকে মশাল চলেছে—এটা কোন দিক?
ওটা দক্ষিণ দিক।
আমরা কোন্ দিকে যাচ্ছি?
আমরাও দক্ষিণ দিকে চলেছি। এ দুটো রাস্তা প্রায় সমান্তরাল, মাঝখানে মস্ত একটা মাঠ আর জঙ্গল।
ও রাস্তাটা গিয়েছে কোন্ পাড়ায়?
ও রাস্তায় প্রথমে পড়ে খিদিরপুর, তার পরে আছে গার্ডেনরীচ, সেটা ঠিক গঙ্গার ধারে-আর ভিতরের দিকে আছে আলিপুর।
আর এ রাস্তাটা?
ভবানীপুর, রসা পাগলা হয়ে গিয়েছে কালীঘাট।
ক-লি-গট! মজার নাম। সেখানে কি আছে?
কালীমাতার মন্দির। জাগ্রত-মানে ‘অল-পাওয়ারফুল’ গডেস।
রাম বসু পাদ্রীদের একমাত্র ভরসাস্থল। তার মুখে কালীর প্রশংসা কেরীর ভাল লাগল না, বলল, মিঃ মুন্সী, তোমাদের দেশ বড় পৌত্তলিক।
রাম বসু বলল, সাহেব, তোমরা এসেছ আর ভাবনা নেই।
টমাস সোৎসাহে বলল, ঠিক কথা। তার পর কেরীর উদ্দেশে বলল, কেমন, আমি বলেছিলাম না?
কেরী বলল, তা বটে। মিঃ মুন্সী, ব্রাদার টমাসের মুখে তোমার সব কথা আমি শুনেছি, আমি জানি যে আত্মীয়স্বজনের ভয়েই তুমি সত্যধর্ম গ্রহণে নিরস্ত আছে।
সে কথা আর বলতে! এবারে দেখ না সাহেব, তুমি ঝাড়ে-বংশে এসেছ, এবারে আমিও ঝাড়ে-বংশে গিয়ে গিঞ্জেয় উঠব।
মনে মনে বলল, মা কালী, কিছু মনে কর না। অসুরগুলোর কাছে এ রকম বলতে হয়, তুমিও তো মা অসুরবধের সময় সরলপন্থা অবলম্বন কর নি। যাই হক মা, অপরাধ নিও না, আগামী অমাবস্যায় গিয়ে ভাল পরে পুজো দিয়ে আসব।
কি ভাবছ মুন্সী?
প্রভু যীশুর সম্বন্ধে একটা গীত রচনা করেছিলাম, সেটা মনে করবার চেষ্টা করছি।
সত্যি?
এসব বিষয়ে কি মিথ্যা বলা সম্ভব?
কই, কি গীত?
কাছে নেই, যত শীঘ্র সম্ভব এনে দেখাব।
মিঃ মূলী, তোমাকে না হলে আমার চলবেই না। আজ থেকেই তোমাকে আমার মুন্সী নিযুক্ত করলাম, এখন মাসিক কুড়ি টাকার বেশি দেবার আমার সাধ্য নেই।
রাম বসু বলল, সাহেব, ধর্মকার্যে টাকা তুচ্ছ।
এ তো হিদেনের মত কথা নয়।
সাহেব, কি আর বলব, আমি ইতিমধ্যেই আধা-খ্রীষ্টান হয়ে গিয়েছি।
টমাস বলল, তুমি এ দেশে খ্রীষ্টান-ধর্মের ভোরের পাখী।
রাম বসু মনে মনে বলল-কি, কুঁকড়ো নাকি?
তিনজনের মধ্যে কথাবার্তা বাংলা ভাষাতেই চলছিল। কেরী বিলাত থেকে আসবার সময় জাহাজে টমাসের কাছে বাংলা পড়তে লিখতে ও বলতে শিখেছিল। তবু এখনও তার মুখের আড় ভাঙে নি, কথাগুলো বেঁকেচুরে যায়, ঠিক শব্দটি ভাবের মুখে আসে না। কুয়াশার মধ্যে যেমন মানুষ দেখা যায় অথচ চেনা যায় না, কেরীর মুখের বাংলা ভাষার চেহারা অনেকটা তেমনি। তবে রাম বসু দীর্ঘকাল সাহেবের মুখের বাংলার সঙ্গে পরিচিত, কেরীর বাংলা বুঝতে তার কষ্ট হল না। টমাস বাংলা পড়তে লিখতে ও বলতে বেশ পারে, প্রায় শিক্ষিত বাঙালীর মতই। কিন্তু সাধারণের পক্ষে কেরীর বাংলা এখন অবোধ্য।
দ্বিতীয় গাড়ির আরোহীদের মধ্যে নিতান্ত বালক ও শিশু বাদে প্রাপ্তবয়স্ক জন স্মিথ ও ক্যাথারিন প্ল্যাকেট। তাদের মধ্যে যে আলাপ চলছিল তা চিত্তাকর্ষক হলেও যে ধর্মসংক্রান্ত নয়, তদ্বিষয়ে একটি তথ্যই যথেষ্ট। মিঃ স্মিথ ও মিস প্ল্যাকেট এখন পরস্পরের কাছে জন ও কেটি। এ-জাতীয় পরিবর্তন এত দ্রুত সচরাচর ঘটে না সত্য, কিন্তু যেখানে ভিড় বেশি, আসন অল্প, সেখানে সাধারণ নিয়ম খাটে না। অনেক সময়েই অশোভন ব্যস্ততায় চেয়ারে রুমাল বেঁধে আপন স্বত্ব চিহ্নিত করে রাখতে হয়।
কেটি বলছিল, জন, তোমাদের রাস্তার নামটি খুব রোমান্টিক বেরিয়াল গ্রাউন্ড রোড়!
জন বলছিল, আর কাছেই আছে প্রকাণ্ড সুনড্রীবন। কাল বিকেলে তোমাকে বেড়াতে নিয়ে যাব।
কেটি বার দুই জিভ দিয়ে ‘সুনড্রী’ শব্দটি নেড়েচেড়ে দেখলেনা হল আয়ত্ত শব্দটি, হল আয়ত্ত অর্থ। সে শুধাল, জন, সুনড্ৰীবন কি বন, কখনও তো শুনি নি?
ওর অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘ফরেস্ট অব বিউটিফুল উইমেন’। ও বন এ দেশ ছাড়া নেই।
কৃত্রিম বিস্ময়ের সঙ্গে কেটি বলল, বল কি, এ দেশ ছাড়া নেই? তাই বুঝি তুমি এ দেশ ছাড়তে চাও না? সর্বনাশ! এখন কি আর স্বদেশের কাউকে তোমার মনে ধরবে?