বড় আনন্দের কথা। ঐ ডিঙিখানায় বোধ হয় ওরা আসছে!
এই বলে স্মিথ অগ্রসর হল।
রাম বসু ও পার্বতী দেখল—হ্যাঁ তারাই বটে, সন্দেহ নেই। টমাসকে বেশ চেনা যাচ্ছে বাকি সকলে সপরিবার কেরী হবে।
ওহে পার্বতী ভায়া, এ যে একগুষ্টি!
দেশে ভাত জোটে না।
আহা, চট কেন? আমাদের ভাত অমনি খাবে না; যেমন আমাদের ভাত খাবে তেমনি আলো বিতরণ করবে।
রামভায়া, তুমি কি সত্যিই ওদের পাত্ৰীভাবে বিশ্বাস কর?
পাগল! রাম বসু কিছুতেই বিশ্বাস করে না, আবার কিছুতেই তার অবিশ্বাস নেই। সমস্ত সংস্কার গলে পান করে সে নীলকণ্ঠ হয়ে বসে আছে!
নীলকণ্ঠ না বলে লালকণ্ঠ বলাই উচিত, সাধারণত ঐ বস্তুটার রঙ লাল হয়েই থাকে—বলে পার্বতীচরণ।
বাপ রে, কি পেল্লায় টাক! কোথায় কপালের শেষ আর কোথায় টাকের শুরু ঠিক করে কোন শালা!
না ভাই, আমার মনে হচ্ছে ওর কপালটা ঠেলতে ঠেলতে ব্রহ্মতালু অবধি উঠেছে। যাই বল, দরাজ-কপালে ব্যক্তি। হা, অদৃষ্ট পরীক্ষা করতে আসছে, দেখা যাবে কত বড় কপাল!
বলা বাহুল্য, এ কপাল-প্রশস্তির লক্ষ্যস্থল স্বয়ং পাদ্রী কেরী। ডিঙিখানা খুব কাছে এসে পড়েছে।
ঐ বেটীই বোধ হয় কেরীর স্ত্রী?
একেবারে বুড়ী যে!
পুষিয়ে নিয়েছে ঐ ছুকরিকে দিয়ে, খাসা দেখতে ভায়া!
বোন নাকি?
বোনই–তবে মনে হচ্ছে গৃহিণীর, নইলে এত যত্নে সাত সমুদ্র পারে নিয়ে আসে না।
বোনই হক আর শালীই হক, স্মিথ দেরি করে এসেও ঠকবে না।
রাম বসু বলল, দেখেছ আমার কথা সত্যি কি না? স্মিথের একবার আগ্রহ দেখ! নৌকায় লাফিয়ে উঠবে নাকি? দেখ দেখ, পড়েছে কাদায়!
সত্যই ভাটার কাদায় স্মিথ খানিকটা লাঞ্ছিত হল।
রামভায়া, চল এগিয়ে যাই।
পাগল নাকি, ঐ সব হাঙ্গামার মধ্যে কখনও যেতে আছে! আগে শত ডাঙায় পা দিক, তখন গিয়ে সরফরাজি করা যাবে। তা ছাড়া, যারা দশ হাজার মাইল পার হয়ে এল—তারা এই দশ গজও পার হতে পারবে, আমাদের সাহায্যের দরকার হবে না।
ইতিমধ্যে সাহেব বিবির দল শুকনো ডাঙায় এসে নামল। যাদের আত্মীয়স্বজন এসেছে, তারা বাড়ির গাড়িতে রওনা হয়ে গেল। যাদের কেউ নেই, তারা গাড়িতে উঠে বলল-Burra Poachkhanna!
কোচম্যান ও পাক্কি-বাহকের দল শব্দটার সঙ্গে খুব পরিচিত, তারা জানে যে Burra Poachkhanna বললে বড় Hotel-এ নিয়ে যেতে হয়। কোন যুবতীকে অবিবাহিত অর্থাৎ বেওয়ারিশ মনে হওয়া মাত্র যুবকের দল তাকে হেঁকে ঘিরে ধরছে। একজন যুবক কেরীর ডিঙির দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই স্মিথের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দেখে ফিরে অন্যত্র গেল।
পরিখাবেষ্টিত কলকাতায় শ্বেতাঙ্গসমাজ Ditchers নামে পরিচিত। Ditcher গণের আর কোন অভাব নেই—ঐ একটি অভাব ছাড়া। তারা চিরন্তন ‘নারী-মন্বন্তর’-এ অভিশপ্ত। শ্বেতাঙ্গিনীর অভাব শ্যামাঙ্গিনী দিয়ে মিটিয়ে নেওয়া সেকালে একটা অর্ধসামাজিক রীতি বলে স্বীকৃত হয়েছিল। নিজে থেকে অন্দরমহলের কথা না বললে কেউ সে প্রসঙ্গ তুলত না, সেটা ছিল নিষিদ্ধ ফলের জগৎ।
.
১.০৩ ঘাট থেকে ঘরে
স্মিথের বাড়ির দুখানা প্রকাণ্ড ব্রহাম গাড়ি বোঝাই হয়ে সবাই ঘাট থেকে ঘরে রওনা হল। সুমুখের গাড়িখানায় একাসনে কেরী ও কেরী-পত্নী, ক্রোড়ে সদ্যোজাত পুত্র জ্যাভেজ; অন্য আসনে রাম বসু ও টমাস। পিছনের গাড়িতে জন স্মিথ, কেরীর শ্যালিকা ক্যাথারিন প্ল্যাকেট, আর কেরীর দুই পুত্র ফেলিক্স ও পিটার; ফেলিক্স ও পিটার বালক। পার্বতীচরণ স্বগৃহে ফিরে গেল, বলে গেল আগামীকাল ভোরে গিয়ে দেখা করবে। রাম বসুও যেতে চেয়েছিল, কেরী হাড়ে নি। দশ হাজার মাইল সমুদ্র সন্তরণ করে এসে কাষ্ঠখণ্ড পেলে কে ছাড়তে চায়! টমাস চাঁদপাল ঘাটেই সকলের সঙ্গে কেরী ও কেরী-পত্নী ডরোথির পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল, এবারে গাড়িতে চেপে বসে আলাপ শুরু হল। আলাপ আলোচনা চলে মুখ্যত কেরী টমাস আর রাম বসুর মধ্যেই; ডরোথি নিতান্ত দু-একটি কথা ছাড়া বলে না; সে অপ্রসন্ন মুখে চুপ করে বসে রইল। তবে রক্ষা এই যে, সন্ধ্যার অন্ধকারে তার মুখের ভাব কেউ তখন দেখতে পেল না।
গাড়ি চাঁদপাল ঘাট থেকে ডাইনে এপ্লানেড, বাঁয়ে কাউন্সিল হাউস ও গভর্নরের কুঠি রেখে এপ্লানেড রো ধরে সোজা পুব দিকে চলেছে। আগে পিছে চলেছে এমন অনেক গাড়ি, অনেক রকমের। প্রত্যেক গাড়ির আগে মশালচি ছুটছে মশালের আলোয় অন্ধকার ঘুচিয়ে, পিছনে হাঁকছে চোপদার ‘সামনেওয়ালা ভাগো’, ‘পিছনেওয়ালা হুঁশিয়ার’। মশালের আলোয় কোচম্যানের বড় বড় চাপরাশগুলো ঝকঝক করে উঠছে। এক সার মশাল ছুটছে পুব দিকে, আর এক সার মশাল ছুটেছে মাঠের মধ্যে দিয়ে দক্ষিণ দিকে। বিশ পঁচিশ পঞ্চাশখানা গাড়ির চাকার ঘড়ঘড়, শ দুই তিন মশালচি ও চোপদারের হুঁশিয়ারি আওয়াজ, অন্ধকার রাত্রি, অপরিচিত দেশ—সমস্ত মিলে নবাগন্তুকদের মনে কি ভাবের সৃষ্টি করল কে বলতে পারে!
কিছুক্ষণ পরে গাড়ি মোড় ঘুরে চৌরঙ্গী রোডে পড়ে দক্ষিণ মুখে চলতে শুরু করল। ঠিক সেই সময়ে ডান দিকের মাঠ-ভরা জঙ্গল থেকে শেয়ালের দল প্রথম প্রহর ঘোষণা করল। হুয়া হুয়া, হুক্কা হুয়া, ক্যাথুয়া ক্যাহুয়া—দূর থেকে দূরান্তরে ছুটে চলে গেল তরঙ্গের পরে তরঙ্গ তুলে।
চকিত কেরী-পত্নী স্বামীকে শুধাল, ও কিসের আওয়াজ?