পার্বতীচরণ শুধাল, তোমার আবার কিসের ব্যবসা?
অ্যাব্রাহাম মুচকি হেসে বলল, কাঁচা চামড়ার ব্যবসা।
দুজনে হো-হো করে হেসে উঠল। বলল, তা বেশ, তা বেশ।
ব্যবসা চলছে কেমন?
কই আর তেমন চলে! এই নতুন জাহাজ পৌঁছলে যা চলে কয়েকদিন।
শুনলাম কোম্পানি জাহাজী গোরাদের জন্যে ‘সেইলরস হোম’ খুলেছে!
তা গোটা দুই খুলেছে বটে।
তবে তো তোমাদের ব্যবসার সদর দরজাটাই বন্ধ।
কিন্তু খিড়কির দরজাটা? সেটা বন্ধ করে কার সাধ্য?
কি রকম?
আগে ডাঙায় নামলে খদ্দের যোগাড় হত, এখন জাহাজে থেকে করতে হয়, তফাৎ এই। খাটুনি বেড়েছে, ভয় বেড়েছে, তেমনি দরও বেড়েছে। অতিরিক্ত পয়সা দিয়ে মরে গোরা খালাসী, আমার মুনাফায় হাত দেয় কে!
কাঁচা চামড়ার ব্যবসায়ের অন্ধিসন্ধি জানবার ঔৎসুক্য জানাল দুজনে।
অ্যাব্রাহাম শুরু করল, তবে শুনুন। সেদিন এল ‘উইলিয়াম অ্যান্ড মেরি জাহাজ। আগে হলে সরাসরি জাহাজে গিয়ে চড়তাম, কিন্তু এখন তা হবার উপায় নেই, পাস লাগে। কি করি? একখানা ডিঙি নিয়ে গেলাম জাহাজের কাছে। কাপেনকে সেলাম করে শুধালাম, হুজুর, জন টমসন বলে কোন যাত্রী এসেছে? কাপ্তেন বলল, না, ও নামে কোন যাত্রী নেই।
তখন আপন মনেই যেন বললাম, তাই তো, বড় মুশকিল হল, এখন কি করি! তারপর আবার কাপ্তেনকে বললাম, একবার হুকুম হলে জাহাজে উঠে জিজ্ঞাসাবাদ করে দেখি কেউ জন টমসনের পাত্তা জানে কি না। এমন তো হতে পারে জাহাজ ছাড়বার আগে কেউ তাকে দেখেছে।
উত্তর হল, বেশ তো, এসে খোঁজ কর না। দেখো জলে পড়ে যেও না যেন।
অমনি তুড়ুক করে জাহাজে লাফিয়ে উঠে জাহাজী গোরাদের মধ্যে ঢুকে পড়লাম। তার পর, রতনে রতন চেনে। ওদের বুঝিয়ে বললাম, ‘সেইলরস্ হোম’ এ কত তকলিফ, কত কড়া আইন, রাত নটার পরে বাইরে বেরুতে দেয় না। আর আমার ঠিকানায় যদি যাও, তবে যা চাও তাই পাবে, ধুম ফুর্তি—চার্জ নামমাত্র।
সবাই একসঙ্গে বলে উঠল-তোমার ঠিকানা বল।
ঠিকানা আবার কি! অ্যাব্রাহামের কুঠি, লালবাজার যা ফ্ল্যাগ স্ট্রীট, বললে কুকুরটা অবধি পথ দেখিয়ে দেবে। খদ্দের ঠিক করে নেমে এলাম।
রামরাম বসু শুধাল, তার পর কি হল বল, ওরা গিয়েছিল তোমার কুঠিতে?
সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আব্রাহাম বলে উঠল, ঐ যে জাহাজ দেখা দিয়েছে। চললাম হুজুর, বহুত বহুত সেলাম।
এই বলে সে একখানা ডিঙির উদ্দেশে ছুটল।
রামরাম বসু ও পার্বতী ব্রাহ্মণ দেখল, সত্যই ‘প্রিন্সেস মারিয়া’ মাঝগঙ্গায় নোঙর করেছে, এবারে পাল গুটোবার আয়োজন করছে, এতক্ষণ কথাবার্তায় মগ্ন ছিল বলে। কিছু দেখতে পায় নি।
ঘাটের দিকে তাকিয়ে দেখল, ইতিমধ্যে সমস্ত স্থানটা তাঞ্জাম, পাল্কি, সেড্যানচেয়ার, ল্যান্ডো, বগি, ব্রাউনবেরি, ফিটন প্রভৃতি বিচিত্র যানবাহনে ভরে উঠেছে। অধিকাংশ গাড়িই খালি, সওয়ারী ধরতে এসেছে। অনেক সাহেব মেম এসেছে আত্মীয়স্বজনকে অভ্যর্থনা করতে। নানা ভাষার কৌতূহল-গুঞ্জনে ঘাটটা মুখর।
রাম বসু ভাবছে, তাই তো, স্মিথ সাহেব এখনও এল না, ব্যাপারখানা কি?
.
১.০২ চাঁদপাল ঘাটে
হ্যালো, মুন্সী!
গুড ইভনিং, মিঃ স্মিথ।
স্মিথ বলল, তোমরা এসেছ ভালই হয়েছে, মিঃ চেম্বার্স তোমাদের ঘাটে উপস্থিত থাকতে বলেছিল। ডাঃ কেরী তোমাকে দেখবার জন্যে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
রাম বসু বলল, তোমাকে না দেখে আমিও ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম।
হ্যাঁ, আমার আর একটু আগে আসা উচিত ছিল।
রাম বসু ইংরেজি পড়তে বলতে লিখতে শিখেছিল, যখন যেমন প্রয়োজন ইংরেজি বা বাংলা ব্যবহার করত। এখন ইংরেজিতেই কথা হল।
মিঃ চেম্বার্স সুপ্রীম কোর্টের ফারসী দোভাষী, কলকাতায় সাহেব মহলে বিখ্যাত। লোকটা টমাসের বন্ধুও বটে, খ্রীষ্টধর্ম প্রচারেও তার অসীম আগ্রহ। স্মিথ ও কেরীর মধ্যে সে যোগাযোগ করে দিয়েছিল, স্থির হয়েছিল যে টমাস ও সপরিবার কেরী স্মিথের আতিথ্য গ্রহণ করবে।
স্মিথ ধনী ব্যবসায়ী, বেরিয়াল গ্রাউণ্ড রোডে বাড়ি।
স্মিথের আসতে বিলম্ব হবার সত্যই কারণ আছে। আজ তার শিকার করতে যাওয়ার কথা। এমন সময়ে তার পিতা জর্জ বলল, জন, শিকারে নাই গেলে, আমি সুস্থ বোধ করছি না, তুমি জাহাজঘাটে গিয়ে মান্য অতিথিদের নিয়ে এস।
জন বলল, সে কি বাবা, শিকারে বেরুব, সব ঠিক, এমন সময়ে—
বুড়ো জর্জ বলল, তাই তো, তাহলে আমাকেই যেতে হচ্ছে দেখছি।
তখন জনের ভগ্নী লিজা বলল, যাও জন যাও, আখেয়ে ভাল হবে। কি ভালটা দেখলে?
চোখ থাকলে তুমিও দেখতে পেতে। কলকাতায় অবিবাহিত যুবকদের গিঞ্জেয় যাওয়ার এত আগ্রহ কেন?
কেন তুমিই বল।
জান না? ভাবী বধু সংগ্রহ।
সে আগ্রহ কি একতরফা?
নিশ্চয়ই নয়, সেই জন্যেই তো আমি কখনও গিয়ে যেতে ভুলি নে।
কিন্তু জাহাজঘাট তো গির্জে নয়।
তার চেয়েও বেশি। অবিবাহিত যুবতী পাকড়াও করবার আশাতেই ওখানে ভিড় জমে।
আমার সে রকম আগ্রহ নেই।
তবে তোমার ভাগ্যে ‘খিদিরপুর অ্যাসাইলাম’-এ যাচাই করা লেখা আছে।
এখন ‘খিদিরপুর অ্যাসাইলাম’-এর ভয়েই হক আর কর্তববুদ্ধিতেই হক জন শিকারে গেল না, জাহাজঘাটে এল। এই তার বিলম্বের আসল কারণ।
রাম বসু বলল, মিঃ জন, এঁর সঙ্গে তোমার পরিচয় নেই, এতক্ষণ পরিচয় করিয়ে দেওয়া উচিত ছিল, এর নাম পার্বতী ব্রাহ্মণ, হিন্দুশাস্ত্রে মহাপণ্ডিত ব্যক্তি, আমার বন্ধু, টমাস ও চেম্বার্সের সঙ্গে এঁর দীর্ঘকাল পরিচয়।