চাঁদপাল ঘাট
চাঁদপাল ঘাট।
১৭৯৩ সালের ১১ই নভেম্বর।
ও-পারের জনশূন্য বাবলাবনের দিগন্তে হেমন্তের সূর্য ডোববার মুখে।
এতক্ষণ ঘাট প্রায় জনশূন্য ছিল, ক্রমে ক্রমে লোকজন জড়ো হতে লাগল, সেই সঙ্গে গাড়িঘোড়াও।
বিলাতী জাহাজ এসে পৌঁছনো একটা মস্ত ঘটনা। আজ পৌঁছবে দিনেমার জাহাজ প্রিন্সেস মারিয়া।
ক্রমবর্ধমান জনতার একান্তে নিমগাছের তলে দাঁড়িয়ে দুজন লোক। একজন লম্বা ছিপছিপে, দাড়ি-গোঁপ কামানো, কথা বলবার সময় কপালে অনেকগুলো রেখা জাগে; অপরজন বেঁটে, শক্ত নিরেট দেহ, ঘাড়ে-গর্দানে এক।
লম্বা লোকটি বলল, পার্বতীভায়া, তোমাকে কেন চটি পায়ে আর নামাবলী গায়ে আসতে বলেছিলাম বুঝতে পারলে কি?
না বসুজা, সত্যি কথা বলতে কি, পারি নি। তুমি বললে তাই এই বেশে এলাম। এ কি ঘাটে আসবার পোশাক! তার পর ভাবলাম, এসব বিষয়ে বসুজা আমার চেয়ে বেশি বোঝে, তাই আর আপত্তি করলাম না।
ভালই করেছ। এই পাদ্রীগুলোর স্বভাব কি জান, যারা দূরে থাকে তাদের উপর বেশি টান। তুমি কোট-পালুন পর, খানা খাও, খ্রীষ্টান হও, দু দিন পরে আর হবে না। আর তা না করে যদি চটি চাদর নামাবলী শিখা বজায় রাখ, একটু অং বং করে দুটো সংস্কৃত মন্তর আওড়াও, তোমার পিছু পিছু ঘুরে বেড়াবে।
সে তো তোমাকে দেখেই বুঝতে পারছি। চেম্বার্স সাহেবের মুন্সীগিরি করলে কত বছর, তার পর টমাস ডাক্তারের সঙ্গে ঘুরলে আরও কত বছর, কিন্তু না উঠল গায়ে কাটাপোশাক, না খেলে অখাদ্য কুখাদ্য। অথচ তোমার উপরই দেখি সবচেয়ে বেশি টান। কেন এমন হয় বলতে পার?
এ সেই ওদের বাইবেলের নিষিদ্ধ ফলের গল্প আর কি। নিষিদ্ধ বলেই টানের অন্ত নেই। জাহাজঘাটায় পৌঁছবার বিলম্ব সয় না, টমাস সাহেবের চিঠির পর চিঠিমুন্সীজি, জাহাজঘাটে হাজির থাকবে।
কিন্তু আবার এই বুড়ো পার্বতী ব্রাহ্মণুকে কেন?
তোমার ব্রাহ্মণত্বেই যে তোমার দাম একটা ব্রাহ্মণকে খ্রীষ্টান করতে পারলে হাজারটা শূদ্রকে খ্রীষ্টান করবার ফল পাওয়া যায়।
কিন্তু একটা শূদ্রকেই বা খ্রীষ্টান করতে পারল কই! আচ্ছা বসুজা, খ্রীষ্টান হবার জন্যে তোমার উপর চাপ দেয় না?
দেয় না আবার!
তবে?
তবে আবার কি? টমাস সাহেবকে বলি, সাহেব, খ্রীষ্টান হয়ে খ্রীষ্টানধর্ম প্রচার করব এ আর বেশি কি। কিন্তু খ্রীষ্টান নই অথচ খ্রীষ্টানধর্ম প্রচার করছি এর প্রভাবটা একবার ভেবে দেখ। সাহেব বলল, ঠিক হ্যায়।
তখন তুমি কি বললে?
আমি কিছুই বললাম না, সাহেবকে ডোমতলার এক জুয়োর আড্ডায় নিয়ে গেলাম। পরদিন সর্বস্ব খুইয়ে সাহেব বলল, মুন্সীজি, জুয়োর আড্ডা নরক। আমি বলি, তা আর বলতে! তার পর সাহেব বলল, টাকাকড়ি হচ্ছে ‘ওয়েজেস অব সিন’। আমি বলি, সেইজন্যেই ওগুলো নরকে গিয়েছে। যা হক সাহেব, এখন তো বেশ হাল্কা হয়েছ, এবার স্বর্গে যাও।
একেবারে মরতে বললে?
আরে না, না। ইশারায় গির্জায় যেতে বললাম। তা ছাড়া, ও যে মরলে স্বর্গে যাবে তা কে বলল?
মনটি বড় সরল।
শুধু সরল মনের জোরে সবাই যদি স্বর্গে যেতে পারত, তাহলে স্থানাভাবে সেখানে যে অন্ধকূপ হত্যার পালা হত।
এবারে আবার কাকে সঙ্গে আনছে?
শুনছি কেরী নামে এক পাদ্রীকে।
একা রামে রক্ষা নাই, সুগ্রীব দোসর!
শুধু সুগ্রীব নয়, সঙ্গে কুমার অঙ্গদ, তারা, নীল, নল, অনেকেই আছে।
সপরিবারে? এ দেশেই থাকবে মনে হচ্ছে!
শুধু থাকবে কেন, বাইবেল তর্জমা করবে, অন্ধকার দূর করবে, প্রভু যীশুর করুণা বৃষ্টি করবে।
অমনি সঙ্গে কিছু রুপোর বৃষ্টি করবে!
অবশ্যই করবে। চেম্বার্স সাহেবকে আমি একসময় বাইবেল তর্জমায় সাহায্য করতাম, সাহেব বেশ দরাজ হাতের লোক।
বসুজা ভায়া, এবারে হুঁশিয়ার হও, এতদিনে খাস পাদ্রীর হাতে পড়বে। চেম্বার্স আদালতে দোভাষী, টমাস জাহাজী ডাক্তার, এ বেটা শুনেছি দীক্ষিত পাদ্রী।
শুধু তাই? কেরী এক সময়ে জুতো সেলাই করত, এখন চণ্ডীপাঠ করে। না জানে এমন কাজ নেই। টমাস সাহেব খুলে লিখেছে কিনা।
এমন সময়ে তাদের কানে গেল, কে যেন গুনগুন করে গান করছে–
‘কলকাত্তাকা বাবুলোক
করে কাম বেহদ,
দিনমে খাতা গঙ্গাপানি
রাতমে খাতা মদ।’
কে, অ্যাব্রাহাম নাকি?
সেলাম বোস সাহেব, অ্যাব্রাহামই বটে।
অ্যাব্রাহাম ও রামরাম বসু দুজনেই ডিঙাভাঙা অঞ্চলের অধিবাসী, পরস্পরকে বেশ চেনে। অ্যাব্রাহামের পিতামাতার কোন একজন কোন এক পুরুষে পর্তুগীজ ছিল, কিন্তু কয়েক পুরুষের ধোপে পিতৃমাতৃপরিচয়ের আজ আর কিছু অবশিষ্ট নেই, আছে শুধু ধমটি, পোশাকটি আর নামটি।
প্রথম পরিচয়ে সে নিজের নাম বলে, ডন অ্যাব্রাহাম ডি লেসে। আর ইংরেজি নিয়ে কেউ যদি ঠাট্টা করে বলে, কেমন সাহেব তুমি! অ্যাব্রাহাম বলে, ইংরেজি কি আমার ভাষা? তার পর সগর্বে বলে, ডন অ্যাব্রাহাম ডি লেসেন্সের ভাষা পর্তুগীজ। আর প্রশ্ন করবার সুযোগ দেয় না, গুন-গুন স্বরে যে কোন একটা গান ধরে, এমন অনেক গানের পুঁজি তার।
রাম বসু শুধাল, তার পর এখানে কি মনে করে?
পার্বতীচরণ বলল, দেশের লোক আসছে দেখতে।
অ্যাব্রাহাম রাগল না, হেসে উঠল, পার্বতীচরণের সঙ্গেও তার পরিচয় ছিল রাম বসুর সূত্রে; তার পরে বলল, দেশের লোক দেখতে ইচ্ছা হয়ই তো। কিন্তু সেজন্যে ঠিক আসি নি, এসেছি ব্যবসার জন্যে।