সেদিন সন্ধ্যার সময়ে গঙ্গার ধারে বেড়াচ্ছিল রাম বসু। এমন সময়ে একটা ভিড় দেখে এগিয়ে গেল; দেখল যে, হোট একটি কচি মেয়েকে, কচি রেশমীর বয়সী হবে, চিতায় তোলার আয়োজন হচ্ছে।
ওরে রাখ রাখ, বলে চীৎকার করে উঠল বসুজা। মেয়েটি প্রাণভয়ে জড়িয়ে ধরল তাকে। সকলে মিলে তাকে ছিনিয়ে নিয়ে ঠেলেঠুলে চিতায় উঠিয়ে দিল। চিতা থেকে নামানোর উদ্দেশ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল রাম বসু। সকলে মিলে তাকে নিবারিত করল। কতক আগুনের ঝলসানিতে, কতক মানুষের ঠেলাঠেলিতে অধচৈতন্য অবস্থায় পড়ে থাকল সে গঙ্গাতীরে।
ন্যাড়া আর নর সেই অবস্থায় তাকে দেখতে পেল সেখানে। একখানা গাড়িতে চাপিয়ে তারা নিয়ে এল তাকে বাড়িতে। তখন সে অজ্ঞান।
পরদিন বৈদ্য এল, নাড়ী দেখে বলে গেল সান্নিপাত, অর্থাৎ কিনা যার আর ঔষধ নেই।
ন্যাড়া গিয়ে খবর দিল কেরীকে। কেরী সাহেব-ডাক্তার নিয়ে এল তখন। ডাক্তার বলল, অবস্থা ভাল নয়।
বিকালবেলা আবার এল কেরী। অনেকক্ষণ শয্যার পাশে বসে থেকে বিষয় মুখে প্রস্থান করল, বলে গেল আগামীকাল সকালেই আবার আসবে।
সারা দিন-রাত অচৈতন্য অবস্থায় কাটে রামরাম বসুর। মাঝে মাঝে ঠোঁট নড়ে।
নরু বলে, বাবা, কি বলছ?
ন্যাড়া বলে, টুশকি দি, কি বলছে দাদা!
টুশকি চুপ করে থাকে, সে জানে কি বলছে মুমূর্ষ।
শেষরাত্রে স্তিমিত দীপ হঠাৎ প্রোজ্জ্বল হয়ে ওঠে, পূর্ণজ্ঞান পায় রাম বসু।
চারদিকে তাকিয়ে দেখে সবিস্ময়ে শুধায়, কই নেই সে?
কে?
কাকে খুঁজছ?
আবার কাকে! এইমাত্র এসেছিল যে!
হঠাৎ জোরে চীৎকার করে ওঠে—ঐ যে, ঐ যে! রেশমী, রেশমী, রেশমী–
ঐ নামের অন্তিম উচ্চারণে জীবনের যাবতীয় আশা-আকাঙ্খা, করুণা, মাধুর্য নিঃশেষ করে দিয়ে এক ফুৎকারে নির্বাপিত হয়ে গেল দীপ।
টুশকি ডুকরে কেঁদে উঠল–কায়েৎ দা, তোমার নরুকে ন্যাড়াকে কার হাতে দিয়ে গেলে?
.
প্রভাত হল। পরম শোকের পরদিবসেও সূর্য তেমনি উজ্জ্বল, বাতাস তেমনি মধুর, আকাশ তেমনি নির্মল আশ্চর্য এই জীবন! আশ্চর্য এই পৃথিবী!
১৮১৩ সালের ৭ই আগস্ট।
–: সমাপ্ত :–