গার্ডেনীচে কলেজের নিজস্ব বাড়ি তৈরি না হওয়া পর্যন্ত রাইটার্স বিভিং-এ কলেজের কাজ চলবে স্থির হল। নীচের তলায় কলেজ ও গ্রন্থাগার, দোতলায় ছাত্রাবাস। বিলাতের বোর্ড অব ডিরেক্টর্সদের নিষেধের ফলে গার্ডেনরীচে কলেজের নিজ বাড়ি তৈরির পরিকল্পনা ওয়েলেসলির স্বপ্নমাত্র রয়ে গেল। যতদিন কলেজ ছিল, রাইটার্স বিন্ডিঙেই চলেছিল তার কাজ। ১৮৫৪ সালে কলেজ বাতিল হয়ে যায়। কলেজের শেষ অবস্থায় স্বয়ং বিদ্যাসাগর যুক্ত হয়েছিলেন কলেজের সঙ্গে।
১৮৮১ সালে কেরী বাংলা ভাষার প্রধান অধ্যাপকরূপে যোগদান করে কলেজে। প্রধানত তার সুপারিশে কয়েকজন পণ্ডিত ও মুন্সী কলেজের চাকুরিতে নিযুক্ত হয়। খ্যাতি ও ভাষাকর্মের দিক দিয়ে মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার ও রামরাম বসু তাদের মধ্যে প্রধান।
একদিন পাঠান শাসনকর্তার উৎসাহে বাংলা পদ্য নৃতন উজ্জীবন লাভ করেছিল। এবারে ইংরেজ শাসনকর্তার উৎসাহে বাংলা গদ্য লাভ করল নাতন উজ্জীবন; সত্যের খাতিরে বলা উচিত যে, বাংলা ভাষায় সাহিত্যিক গদ্যের হল যথার্থ ভিত্তিপত্তন। ফোট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠায় ইংরেজ সুশাসনের কতটা উন্নতি হয়েছিল সে বিচার করুক ঐতিহাসিকের দল; ভাষাবিচারকের রায় হচ্ছে এই প্রতিষ্ঠান নূতন বাংলাসাহিত্যের সূত্রপাত করে দিল। শাসন-সৌকর্যের উপলক্ষ্যকে ছাড়িয়ে গেল ওয়েলেসলির আকাকা। আমাদের কাহিনীর পক্ষে কলেজের বিস্তারিত ইতিহাস অবান্তর। কেরী ও তার মুগীর নূতন কর্মক্ষেত্ররূপে যেটুকু প্রয়োজন তা-ই বলা হল।
মদনাবাটিতে বাংলা গদ্যসৃষ্টিতে কেরীর ব্যক্তিগত প্রয়াস, শ্রীরামপুরের মিশনে পাদ্রীদের সঙ্গে মিলিত প্রয়াস আর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে এসে সেই প্রয়াস পেল রাজকীয় সমর্থন ও সাহায্য। তিন জায়গাতেই রামরাম বসু তার মুন্সী, তার প্রধান সহায়।
কিন্তু কেরী দেখল যে, তার মুন্সীর কোথায় যেন পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। আগের সে উৎসাহ, কর্মশক্তি আর নেই; নেই সে অসাধারণ বাকপটুতা ও ক্ষিপ্রবুদ্ধি, যা দীর্ঘকাল মুগ্ধ করে রেখেছিল পাদ্রীদের। এখন সে কেমন যেন নিস্তেজ, অন্যমনস্ক। খান-দুই বই লিখে সেই যে তার কলম নেতিয়ে পড়ল, হাজার উৎসাহ-উদ্দীপনাতেও আর তা সরল না। কেরী দেখে যে, কলেজের কাজে মুন্সীব শ্লাগ্রহ নেই, সব দিন নিয়মিত আসে না, অনেক সময়েই আগে চলে যায়।
একদিন সে শুধাল, মুন্সী, তোমার কি শরীর অসুস্থ?
না, তেমন কিছু নয়, বলে প্রশ্নটাকে পাশ কাটিয়ে গেল রামরাম বসু।
কিছুদিন বিশ্রাম নাও না কেন!
কেরীর অত স্বরে সে বলল, এবারে একবারেই বিশ্রাম নেব।
কেরী ঠিক বুঝতে পারে নি বসুর আঘাতটা ঠিক কোথায়, আর তার গুরুত্ব কতখানি। নিজের জীবনেও সে কম আঘাত পায় নি; কিন্তু ভেঙে পড়ে নি কখনও।
এমন লোকের পক্ষে পরের মনোভঙ্গের কারণ বা গুরুত্ব বোঝা সহজ নয়।
কেরী ও রামরাম বসুর গড়ন কেবল ভিন্ন নয়, ওরা ভিন্ন ধাতুতে গঠিত। মধ্যযুগীয় জীবনের ভিত্তি ভগবদবিশ্বাস। তা বিচলিত হলেও একবারে ভেঙে পড়ে না। নব্যযুগের জীবনের ভিত্তি আপন ব্যক্তিত্বে বিশ্বাস। বিচলিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা ভেঙে পড়ে, আপনার উপরে আপনি দাঁড়াতে পারে না। কেরীর জীবন বেঁকে পড়েও দাঁড়িয়ে থেকে আজ পর্যন্ত বিস্ময় উদ্রেক করছে। রামরাম বসুর আমূল-ভেঙেপড়া জীবন করুণা জাগায় দর্শকের মনে।
.
৫.৫ শেষ অধ্যায়
টুশকি বলে, কায়েৎ দা, আজকে কলেজ না-ই গেলে, শরীরটা তেমন ভাল নেই দেখছি।
বেশ আছি, বলে চাদর কাঁধে ফেলে বেরিয়ে যায় সে।
সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়ে গেলেও যখন সে ফেরে না, ন্যাড়া বের হয় সন্ধানে। অনেক খোজাখুঁজি করে গঙ্গার ধার থেকে তাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। এমন ঘটনা এখন প্রায় নিত্য ঘটে।
কখনও কখনও গভীর রাতে দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ে সে। খোলা দরজা দেখে ন্যাড়া আর টুশকি বোঝে যে কখন বেরিয়ে গিয়েছে তাদের কায়েৎ দা। তখন নরু আর ন্যাড়া অন্ধকারের মধ্যে খুঁজতে বেরিয়ে পড়ে।
এমন দিনের পর দিন, রাতের পর রাত চলে। আবার যখন ঘরে থাকে, না ঘুমোয় সে দিনে, না ঘুমোয় রাতে। হয় চুপটি করে বসে থাকে, নয় আপন মনে গুনগুন করে গান করে।
টুশকি বলে, এমন করে কদিন চলবে কায়েৎ দা! চল না, কোথাও থেকে ঘুরে আসি।
কখনও কোন উত্তর দেয় না সে, কখনও বলে, কি হবে? মনের আগুন যে সঙ্গে যাবে।
মনের আগুন কি আর নিভবে না?
কেন নিভবে রে টুশকি, কেন নিভবে!
তার পরে একটু ভেবে বলে, যে আগুনে সে পুড়ে মরেছে, এর জ্বালা কি তার চেয়েও বেশি! তারপর হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে বলে ওঠে, দেব না নিভতে এ আগুন, কখনও দেব না।
হঠাৎ হেসে উঠে সে বলে, সহমরণে পুড়ছি রে, তার সঙ্গে সহমরণে পুড়ে মরছি।
টুশকি ভাবে, পাগল হতে আর দেরি নেই। টুশকি বোঝে তার জ্বালা, তাই তারই কাছে কখনও কখনও মনের কথা প্রকাশ করে বসুজা, আয় সকলের কাছে সে নির্বাক।
সকলে ভাবে, বুড়ো পাগল হয়ে গিয়েছে; টুশকি জানে তার জ্বালা কোথায়, সে ও যে ঐ জ্বলুনির সঙ্গী।
.
অনেক রাত্রে ন্যাড়াকে ঠেলে জাগিয়ে টুশকি বলল, ওরে কায়েৎ দা তো এখনও ফিরল না, একবার বেরিয়ে খুঁজে দেখ!
তখনই বেরিয়ে পড়ল ন্যাড়া আর নরু। তারা জানত গঙ্গার ধারটা তার বড় প্রিয়, সেই দিকেই চলল দুজনে।