মুন্সী হেসে বলে, ব্যস তো হল।
এমন আর কি বয়স হয়েছে তোমার?
তা মন্দ আর কি, পঞ্চান্ন পেরিয়েছে।
পঞ্চান্ন এমন কিছু বেশি নয়, কিন্তু এ যে হঠাৎ বুড়িয়ে গিয়েছ, মুখ-চোখের চেহারা আগুনে ঝলসানো গাছের মত।
রাম বসু ভাবে, আগুনে ঝলসানো গাছই বটে। প্রকাশ্যে বলে, এখন জনের খবর বল, কোথায় আছে, কেমন আছে, কবে ফিরবে খুলে বল! আহা, বেচারার জন্যে বড় দুঃখ হয়।
এবারে আবার পূর্বকথা উত্থাপন করতে হল। রেশমীর মৃত্যুর পরে জন কোম্পানির চাকরি নিয়ে বোম্বাই প্রেসিডেন্সিতে চলে গেল। লিজা অনেক কাকুতি-মিনতি, অনেক উপরোধ-অনুরোধ করেছিল, চোখের জলও কম ফেলে নি–কিন্তু জনের সঙ্কল্প টলল না।
লিজা বলল, জন, বিয়ে করে সংসারী হও।
জন বলল, বার বার তিনবার তো পরীক্ষা হল, আর কেন? বিয়ে আমার জন্যে নয়।
লিজার মনে পড়ে কেটি, রোজ এলমার, রেশমীর কথা।
এ সব বিষয়-সম্পত্তি ভোগ করবে কে?
লিজা, তুমি ভোগ করবে, আর কখনও যদি আমি ফিরে আসি, আমিও ভোগ করব।
নির্বোধ জন বোম্বাই যাত্রার আগে একটি বুদ্ধির কাজ করল, মেরিডিথের সঙ্গে লিজার বিয়ে দিয়ে দিল। সে মেরিডিথকে বলল, ফেও, আমার বোনটিকে তোমাকে দিয়ে গেলুম, এর চেয়ে মূল্যবান আমার আর কিছু নেই, ওর অযত্ন কর না, এমন নারীর বিরল।
মেরিডিথ কোন কথা না বলে সজোরে তাব করমর্দন করে প্রত্যুত্তর দিল।
জন পুনার ইংরেজ রেসিডেন্টের এডিকং।
এখানে একটু এগিযে পরের কথা আগে সেরে নিই।
১৮১৮ সালে তৃতীয় মারাঠা যুদ্ধে জনের মৃত্যু ঘটে। পুনার উপকণ্ঠে এখনও তার সমাধিস্তম্ভ দেখতে পাওয়া যায়। সমাধির প্রস্তরফলকে শুধু তার নাম লেখা আছে জন স্মিথ। আর লেখা আছে–”এখানে তার দেহ সমাহিত, যার আশা-আকাকা অনেক আগেই সমাহিত হয়েছে।” এইভাবে কঠিন পরীক্ষাময় করুণ জীবন সমাপ্ত হল হতভাগ্য জনের।
বসু শুধায়, জন কি আর ফিরবে না?
তেমন সম্ভাবনা আছে বলে তো মনে হয় না।
মিসেস মেরিডিথ একবার ভাল করে অনুরোধ করে দেখুন না।
সে চেষ্টা হয় নি বুঝি?
কি বলে জন?
সে বলে, কলকাতার ক্ষতচিহ্ন থেকে দূরে এসে স্বস্তিতে আছে, যদিচ শান্তি আর এ জীবনে মিলবে না তবু স্বস্তিটাই বা কম কি! সে লিখেছে, কলকাতায় ফিরে গেলে বেশিদিন আর বাঁচবে না, তাই ও অনুরোধ যেন তাকে না করা হয়।
রাম বসু বলে, এর পরে আর কথা কি! তা যেখানে থাকলে স্বস্তিতে থাকে থাকুক।
লিজাও সেই কথা বলে, মুলী, একদিন বিকেলে আমাদের বাড়িতে যেও। লিজা প্রায়ই তোমার কথা বলে। বলে যে, মুগী যতটা বুঝত জনকে-এমন আর কেউ নয়।
মুন্সী মনে মনে বলে, দুজনেই যে এক আগুনে ঝলসানো।
প্রকাশ্যে বলে, মিসেস মেরিডিথকে আমার বহুৎ বহুৎ সেলাম দিও, আমাকে মনে রাখবার জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ জানিও।
গাড়ি জানবাজার রোডে এসে পড়লে মুন্সীকে নামিয়ে দিয়ে ফ্রি স্কুল স্ট্রীট ধরে চলে যায় মেরিডিথ বেরিয়াল গ্রাউণ্ড রোডের দিকে, বলে যায়, সময় পেলে যেতে ভুলো না মুন্সী।
মুন্সী আবার ধন্যবাদ জানায়। তার পরে মনে মনে ভাবতে ভাবতে চলে, রেশমী অনেকের অনেক পরিবর্তন সাধন করে গিয়েছে তাদের মধ্যে এই পরিবারটিও। নইলে এরা সেধে নেটিভ জেন্টুকে বাড়ি নিয়ে যেতে চাইত না। মেরিডিথ যেতে যেতে ভাবে মুন্সী দেহেমনে একবারে ভেঙে পড়েছে, বোধ করি আর বেশিদিন বাঁচবে না; ভাবে, জনের মতই তার অবস্থা। তখন হঠাৎ বিদ্যুৎ-ঝলক দিয়ে যায় তার মনে, জনের মত তবে কি মুন্সীও ভালবাসত রেশমীকে? তার মন বলে, অমন অপূর্ব লাবণ্যময়ী নারীকে ভাল না-বাসাই যে আশ্চর্য!
.
৫.৪ একটি নীরব অধ্যায়
লর্ড ওয়েলেসলি বাদশাহী মেজাজ নিয়ে এসেছিল এদেশে। সে বুঝেছিল যে ঈস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অ্যাডভেঞ্চারের যুগ অবসিত, এবারে আরম্ভ হবে বাদশাহী যুগ; মুঘল বাদশাহীর পরবর্তী অধ্যায় ঈস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাদশাহী। গোড়া ঘেঁষে সাম্রাজ্যপত্তনে মনোনিবেশ করল ওয়েলেসলি। পাঠান ও মুঘল বাদশাহেরাও একদিন বুঝেছিল যে, রাজকীয় স্বার্থের অনুরোধে দেশীয় ভাষার সঙ্গে পরিচয়-সাধন আবশ্যক। ভাষার ঐতিহাসিকগণ বলে থাকেন যে, পাঠান শাসকদের সময়েই বাংলা ভাষার চর্চা বাড়ল, বাংলা সাহিত্যের উন্নতি আরম্ভ হল। ওয়েলেসলির সিদ্ধান্তেও অনুরুপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিল। সেকালে পনেরো-ষোল বছরের নাবালক ইংরেজ রাইটার (পরবর্তীকালের সিভিলিয়ান) হোকরার দল এদেশে আসত; তারা না জানত দেশের ভাষা, না জানত দেশের ইতিহাস, আইন প্রভৃতি। ইংরেজী ভাষা ও পাঁচ টাকা বেতনের দোভাষীর সাহায্যে যেভাবে দেশ শাসন করত তারাতা কুশাসন, অত্যাচার ও খামখেয়ালির নামান্তর। ওয়েলেসলি বুঝল, এভাবে আর যাই হক, বাদশাহী শাসনের উত্তরাধিকার গ্রহণ চলে না। প্রজার মুখে রাজার সুনাম রাজগীর পক্ষে অত্যাবশ্যক। তাই ওয়েলেসলি সিদ্ধান্ত করল যে, রাইটারগণকে দেশী ভাষা শিক্ষা করতে হবে, তবে তারা পাবে শাসনকার্যের ভার। তখন দু-একজন ইংরেজ হিন্দুস্থানী ভাষা শিক্ষা দেওয়ার জন্যে সেমিনার খুলেছিল। ওয়েলেসলি দেখল যে অভিলষিত কাজের কোন ব্যবস্থা নেই। তখন এই উদ্দেশ্যে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ নামে এক কলেজের প্রতিষ্ঠা হল। সেটা ইংরেজী ১৮০০ সালের কথা। এই কলেজে সংস্কৃত, আরবী, ফারসী, হিন্দুস্থানী, মারাঠী, বাংলা প্রভৃতি ভাষা শিক্ষাদানের ব্যবস্থা হল। বর্তমান প্রসঙ্গে কেবল বাংলা ভাষার কথাই বলা হবে।