রাম বসুর মনটা দমে যায়, বিদ্যালঙ্কার বলেছিল ধৈর্য চাই, এখানেও সেই কথা ধৈর্য চাই–ধৈর্য চাই। কিন্তু মানুষের আয়ু যে পরিমিত, আর কতদিন বাঁচব, ভাবে রাম বসু। রেশমীর আত্মার তৃপ্তি না দেখেই কি তবে তাকে মরতে হবে। সে ভাবে-ধৈর্য দেবতার, ত্বরা মানুষের।
কিন্তু মনের কথা মনে চেপে রেখে রামমোহনকে সমর্থন করে সে বলে, আপনি যা বললেন তা সত্য। কেরী, হেয়ার প্রভৃতি পাঁচজন গোরাকে স্মরণ করে ‘পঞ্চকন্যা শ্লোকের অদির্শে লোকে এখন বলে থাকে
“হেয়ার কম্বিন পামরশ্চ
কেরী মার্শমেনস্তথা
পঞ্চগোরা স্মরেন্নিত্যং
মহাপাতকনাশনং।”
রামমোহন বিস্ময়ে বলে ওঠেন, বাঃ বাঃ, বেশ লিখেছে তো, বলে তিনি শ্লোকটার পুনরাবৃত্তি করেন।
রাম বসু অবাক হয়ে যায় রামমোহনের স্মৃতিশক্তি দেখে।
তার পরে রামমোহন বলেন, তুমি একটা শ্লোক শোনালে, আমি তবে একটা শোনাই শোন–
“সুরাই মেলের কুল,
বেটার বাড়ি খানাকুল,
ওঁ তৎসৎ বলে বেটা
বানিয়েছে এক স্কুল!
ও সে জেতের দফা করলে রফা,
মজলে তিন কুল।”
শ্লোকটা যে রামমোহন সম্বন্ধে–শুনেই বুঝল রাম বসু, কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত হয়ে সে বলল, ও সব বাজে লোকের কথা ছেড়ে দিন দেওয়ানজী।
মিছে লজ্জা পাচ্ছ মুন্সী, আমি কি ও সব লোকের কথার মূল্য দেওয়ার বান্দা! তুমি একটা শ্লোক শোনালে তাই আমিও শুনিয়ে দিলাম—এই আর কি। তবে কি জান, আমার সঙ্গে বহু বিশিষ্ট লোক আছেন যারা আমার ডান হাত বাঁ হাত। আছেন দ্বারিক ঠাকুর, কালীনাথ রায়, রামকৃষ্ণ সিংহ, তেলিনীপাড়ার অন্নদাপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়-আরও কতজন।
তার পরে তিনি বলেন, আশার কথা হচ্ছে এই যে, নৃতন যুগের হাওয়া উঠেছে, একে থামায় এমন সাধ্য কারও নেই। প্রথমেই লাগতে হবে সহমরণ প্রথার বিরুদ্ধে।
আবেগের সঙ্গে মুন্সী বলে ওঠে, আগুন দেওয়ানজী লাগুন, বুকের মধ্যে নিত্য আগুন জ্বলছে।
এই তো চাই মুন্সী, দেশের আগুন বুকের মধ্যে অনুভব করলে আর ভাবনার কারণ থাকে না। আমার বুকে আগুনের জ্বালা বড় অল্প নয়, এই ক’মাস আগে আমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতৃবধূ সহমৃতা হয়েছেন।
বিদ্যালঙ্কারের কথার প্রতিধ্বনি করে রাম বসু বলে, দেশব্যাপী এ প্রথা দূর করতে হলে চাই উদ্যম, কর্মকৌশল, চাই যুগযন্ত্রটাকে চালনা করার পারদর্শিতা, শুধু জ্ঞানে কিছু হবে না। তেমন লোক তো আপনাকে ছাড়া দেখি নে।
দাঁড়াও, আগে কলকাতায় এসে স্থায়ী হয়ে বসি, তার পর লড়াই শুরু করব নারীভক দানবটার সঙ্গে।
এমন সময়ে একজন চাকর শ্বেতপাথরের থালায় মিষ্টি ও ফল আর তেপাথরের বাটিতে তরমুজের শরবৎ নিয়ে এসে দাঁড়াল।
রাম বসু বলে উঠল, এ সব আবার অসময়ে কেন, অসুখ হবে যে।
রামমোহন বললেন, আর মিষ্টিমুখ না করে গেলে গেরস্তর অকল্যাণ হবে না? নাও, তুমি ওগুলো মুখে দিয়ে মুখ চালাও, আমি বকতে বকতে মুখ চালাই।
রাম বসু খেতে শুরু করে, রামমোহন তাঁর ভবিষ্যৎ সমাজসংস্কার-পরিকল্পনা সম্বন্ধে বলে যান।
রাম বসু খেতে খেতে লক্ষ্য করে রামমোহনের নগ্নকান্তি। সে ভাবে, পোশাক পরিচ্ছদ খুলে নিলে অধিকাংশ মানুষকে পালক-ছাড়ানো মুরগীর মত দেখায়। অথচ এঁকে! পোশাক-পরিচ্ছদে যেন এঁর প্রকৃত বিভূতি আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। তার মন বলে ওঠে, বিনা ভূষণে যাকে মহৎ মনে হয় মহাপুরুষ বলি তাকে।
বুঝলে বসুজা, রংপুরের কালেকটার ডিগবি সাহেব ছাড়তে চান না আমাকে; বলেন, দেওয়ান, তুমি গেলে আর একজন দেওয়ান অনায়াসে পাব কিন্তু আর একজন রামমোহন তো মিলবে না। তিনি বলেন, সমাজ-সংস্কার করতে চাও, বেশ তো, রংপুরে আরম্ভ কর না কেন, এখানকার প্রয়োজন তো অল্প নয়। বুঝলে বসুজা, আমি তাঁকে অনেক বলে-কয়ে রাজী করেছি, আর বড়জোর তিন-চার বছর থাকব ওখানে। তার পরে চলে এসে স্থায়ীভাবে বসব কলকাতায়। তখন তোমাদের নিয়ে শুরু করে দেব লড়াই।
নৈরাশ্য চেপে শোনে রাম বসু। রামমোহন বলেন, আমাদের একদিকে শত্ৰ পাদ্রীর দল আর একদিকে শত্র ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতের দল। দো-হাত্তা লড়াই করতে হবে আমাদের। ধৈর্য ধর বসু, ধৈর্য ধর, সময়ে সব হবে।
সময়ে সব হবে কিন্তু এ জীর্ণ খাঁচাটা কি আর ততদিন টিকবে, ভাবে বসুজা।
অবশেষে বিদায় নিয়ে উঠে পড়ে রাম বসু। রামমোহন বলেন, মাঝে মাঝে এসো হে, তোমাদের মত উৎসাহী লোক আছে জানলে মনে বল পাওয়া যায়। আর বাংলা লেখার অভ্যাসটা ছেডো না। ফিরে এসে বসি না, আমিও শুরু করব বাংলা রচনা। আরবী-ফারসীতে মনের কথা প্রকাশ করে তৃপ্তি হয় না।
.
রাম বসু বাহার সড়ক ধরে বাড়ি ফেরে। এবারে তার গতি মন্থর, পদক্ষেপ ক্লান্ত। অনেক আশা-ভরসা নিয়ে এসেছিল সে, অপেক্ষা করার উপদেশ পেয়ে মন গেল ভেঙে। জ্ঞানের প্রেরণা যার, কর্মের প্রেরণা যার সে পারে অপেক্ষা করতে, কিন্তু মনে যার আগুন জ্বলছে তার পক্ষে সময়ক্ষেপ যে অসহ্য। দীর্ঘনিশ্বাসে বেরিয়ে আসে বুকের তাপ।
এমন সময়ে সে শুনতে পেল কে যেন ডাকছে, হ্যালো মুন্সী, হ্যালো মুন্সী!
কে ডাকে? পিছনে ফিরে দেখল মেরিডিথ আসছে ফিটন হাঁকিয়ে।
ফিটন কাছে এসে পড়লে মেরিডিথ বলল, মুন্সী, উঠে বস, অনেক কথা আছে। সম্প্রতি জনের চিঠি পেয়েছি।
জনের নাম শুনে আগ্রহে ফিটনে চাপে মুন্সী।
তারপর মুন্সী, অনেককাল তোমাকে দেখি নি। কিন্তু এ কি, একবারে যে ভেঙে পডেছ!