অবশেষে মাইলদেড়েক পথ চলবার পরে মানিকতলায় এসে উপস্থিত হল রাম। বসু। রাস্তার বাঁ-ধারে গেটওয়ালা প্রকাও বাড়িটা সহজেই চিনতে পারল, প্রবেশ করল বাড়ির বিস্তৃত হাতার মধ্যে।
একজন চাপরাসধারী ভিসা করল, কাকে চান?
দেওয়ানজীর সঙ্গে দেখা করতে চাই।
সে সসম্ভ্রমে বলল, আসুন আমার সঙ্গে।
দেওয়ানজীর দ্বার অবারিত।
.
৫.৩ দেওয়ানজী
দারোয়ানের সঙ্গে চলল রাম বসু। প্রকাও হাতার মধ্যে ফলের বাগান, বাগানের মাঝখানে একতলা ছডানো মস্ত বাড়ি। বাড়ির পিছন দিকে পৌঁছে রাম বসু দেখল যে সেখানেও নানাজাতীয় ফলের গাছ। এমন সময়ে নজরে পড়ল মাঝারি আয়তনের একটা পুকুরের পাশে বড় একটা লিচু গাছের ছায়ায় শ্বেতপাথরের জলচৌকির উপরে আসীন রামমোহন, দুজন পশ্চিমে বেহারা তৈল মর্দন করছে তার গায়ে। এর আগে সে বার কয়েক রামমোহনকে দেখেছে, সামান্য মুখচেনাও ছিল। তখন দেখেছে তাঁকে বাইরের পোশাকে, শালের চোগা-চাপকানে মণ্ডিত। এখন খালি গায়ে, খাটো তেলধুতি-পরা অবস্থায় দেখে তার ভারি মজা লাগল। দূরে থেকেই চোখে পড়ে দেহের বিপুল পালোয়ানী আয়তন। আবার মনে পড়ল রঘুবংশে পড়া দিলীপের চেহারার বর্ণনা। মনে মনে সে বলে উঠল, একেই বৃটোরস্ক, বৃষস্কন্ধ বলে বটে।
রামমোহনের কাছে গিয়ে প্রণাম করতে উদ্যত হলে তিনি বলে উঠলেন, না না, তৈলাক্তদেহে প্রণাম গ্রহণ করতে নেই। ব’স বেরাদার ওখানে।
এই বলে তিনি একখানা জলচৌকি দেখিয়ে দিলেন।
রাম বসু বলে উঠল-বড় অসময়ে এসে পড়লাম।
কিছু না, কিছু না, সব সময়ই সুসময়। তাছাড়া অতিথি যদি সময় বিচার করে আসবে, তবে আর তাকে অতিথি বলেছে কেন?
একটু থেমে শুধালেন, কেমন, আর গীত রচনা করলে?
সলজ্জ হাসিতে বসুজা বলল, আজ্ঞে না, আর নূতন কিছু রচনা করি নি।
কয়েক বছর আগে একটা স্বরচিত “যীশ-সঙ্গীত”-কে “ব্রহ্ম-সঙ্গীত” বলে শুনিয়ে গিয়েছিল সে। বিশেষ আয়াস করতে হয় নি, “যীশু” শব্দের বদলে “ব্ৰহ্ম” শব্দটি বসিয়ে দিয়েছিল মাত্র। রামমোহন খুব প্রশংসা করেছিলেন গীতটির।
এবারে রামমোহন বললেন, বসুজা, তোমার প্রতাপাদিত্য-চরিত বইখানা পড়েছি।
সে ভয়ে ভয়ে শুধায়, কেমন লাগল?
বসুজা জানে, বাংলা ভাষায় আঁচড় কাটলেই ইংরেজ পাত্রী প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠে। কিন্তু এ ইংরেজ পাত্রী নয়, শিক্ষিত বাঙালী, তাও আবার একেবারে বাথ ভালুক।
রামমোহন বলেন, ও বই তুমি ছাড়া আর কেউ লিখতে পারত না-ওর মধ্যে কাহিনীর আকর্ষণ সঞ্চারিত করে দিতে পেরেই। ওটা মস্ত গুণ। কিন্তু কি জান, ওটা জীবনচরিত হয় নি, হয়েছে ইতিহাস।
পাছে বসুজা নিরুৎসাহিত হয়, তাই শুধরে নিয়ে বললেন, তা হক, বাংলা গদ্যের প্রথম রচনা হিসাবে বইখানা স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
তার চেয়ে আর বেশি কি আশা করতে পারি দেওয়ানজী!
তোমরা ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে যে-কাজ করহ তার তুলনা নেই। কোম্পানি ভাবছে রাইটারদের বাংলা ভাষা শেখানোর ব্যবস্থা হচ্ছে, পাত্রীরা ভাবছে বাইবেল অনুবাদের যোগ্য ভাষা তৈরি হয়ে উঠেছে, কিন্তু হচ্ছে তার চেয়ে অনেক বেশি।
রামমোহন বলে যান, বেহারারা সশব্দে উদার বক্ষে, প্রশস্ত পৃষ্ঠে, যুগন্ধর স্কন্ধে সশব্দে তৈল মর্দন করে আর রাম বসু লক্ষ্য করে রামমোহদের দেহের সৌষ্ঠব ও বৈশিষ্ট্য। সে লক্ষ্য করে মখমণ্ডলের অনুপাতে চোখ দুটি ছোট, কিন্তু উজ্জ্বল, অথচ কেমন একটি স্নিগ্ধ ভাব তাতে, রৌদ্রভাস্বর জলের উপরে স্নেহপদার্থ বিস্তারিত। সরল নাসিকাটির মাঝখানে একটুখানি অতর্কিত উচ্চতা, উপরের পাটির সম্মুখের একটা দাঁত ঈষৎ ভগ্ন, চিবুকের নীচে চওড়া কাটা দাগ।
বসু বোঝে, মনে মনে হাসে-বাল্যকালে খুব শান্তশিষ্ট ছিল দেওয়ানজী!
রামমোহন যোগ) শ্রোতা পেয়ে বলে যান, আর যোগ্য দর্শনীয় পেয়ে রাম বসু লক্ষ্য করে যায়-ঘোট ঘোট কান দুটো দেহের সঙ্গে সংলগ্ন, তৈলচিক্কণ লম্বিত বাবরি, রোমশ বক্ষস্থল, আর হাঁ, যুগের অর্গল উন্মুক্ত করবার উপযুক্ত সুস্পষ্ট সুদীর্ঘ বাহুদ্বয়, আর সেই বাহুর প্রান্তে রক্তাভ করতলের সঙ্গে যুক্ত সুঠাম সুডৌল অঙ্গুলিগুলি। ডান হাতের অনামিকায় উজ্জ্বল রক্তিম পলার আঙটি; বাম হাতের অনামিকায় অঙ্গুরীয়টি শাখার। গলায় মালাকারে দোদুল্যমান শুভ্র সূক্ষ্ম উপবীত।
আশ্চর্য ঐ লোকটি কেরী! জ্ঞান, কর্ম, হৃদয়বত্তার এমন শুভ যোগাযোগ বিরল। বলে যান রামমোহন, বিধাতা কাকে দিয়ে কোথায় যে কি কাজ করিয়ে নেন, মানুষের সাধ্য কি বোঝে! বিধাতা এক হাতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ক্লাইভকে আর এক হাতে পাঠিয়ে দিলেন কেরীকে, এক হাতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন হেস্টিংসকে, আর এক হাতে পাঠিয়ে দিলেন হেয়ারকে, দুই হাত লাগিয়েছেন তিনি এদেশকে জাগাবার কাজে। ক্লাইভ, হেস্টিংস এদেশকে বাঁধছে শাসনের জালে, আর কেরী, হেয়ার এদেশকে মুক্তি দিচ্ছে আত্মার অধিকারে। বন্ধনে আর মুক্তিতে কেমন সহযোগিতা করে চলেছে, লক্ষ্য করেছ কি?
এত কথা বাম বসু ভাবে নি, তখনকার দিনে কেউ ভাবত না-তাই সে চুপ করে থাকল।
দেখছ না, বাংলা ভাষা গড়ে উঠছে, ইংরেজী শিক্ষার বিস্তার হচ্ছে, আবার চাই কি! দেখতে দেখতে যাবতীয় কুসংস্কার, গঙ্গাসাগরে সন্তানবিসর্জন, সতীদাহ, পৌত্তলিক হিন্দুধর্ম প্রাচীন যুগের ভূতের মত দূর হয়ে যাবে। নিশ্চয় যাবে বসুজা, নিশ্চয় যাবে; দেখছ না, চারিদিকের সব দরজা-জানলা যে খুলে গিয়েছে, পশ্চিমের হাওয়া ঘরের মধ্যে ঘুম ভাঙিয়ে মাতামাতি শুরু করে দিয়েছে। পালে লেগেছে হাওয়া, এবারে হাল ধরে লক্ষ্য স্থির করে ধৈর্য ধরে বসে থাকা আবশ্যক। ধৈর্য চাই বসুজা-ধৈর্য চাই।