মদনাবাটির সেই ব্যর্থ অভিসারের অভিজ্ঞতায় রাম বসু বুঝেছিল যে, ও মেয়ে হাতে পাওয়ার নয়। দুষ্প্রাপ্যতার কুয়াশায় সে হয়ে উঠল আরও লোভনীয়, আরও রমণীয়, আরও রহস্যময়। তার পর থেকে তাকে কেন্দ্র করে ঘুরে মরছে রাম বসুর জীবন। গ্রীক পুরাণের কাহিনী সে পড়েছিল, বুঝেছিল যে, গ্রীসের সমস্ত কল্পনা সংহত হয়ে জ্বলে উঠেছিল একটি পাবকশিখারূপে, সে হচ্ছে হেলেন। গ্রীসের কাব্য পুরাণ জীবন ঐ পাবকশিখার চারদিকে মুমূর্ষ পতঙ্গের মত ঘুরে মরেছে। ঘুরে মরেছে এই দশ বছর রাম বসুর জীবন রেশমীর চারদিকে। যখন সে বেঁচে ছিল তখন তার আকর্ষণ প্রবল ছিল, মৃত্যুর পরে সে আকর্ষণ হয়েছে প্রবলতর। রূপজ কামজ সম্বন্ধের এ প্রকৃতি তো নয় এমন কি প্রেমজ সম্বন্ধেরও বুঝি নয়। এ আর কি। ভাল করে বুঝতে পারে না সে কি এ। কতদিন বুঝতে চেষ্টা করেছে, পারে নি। আজ যখন টুশকি এল সেই পুরনো দিনের হাওয়া পালে নিয়ে, তখন সেই দমকা বাতাসে তার মনের গুটানো নিশান খুলে গিয়ে বিস্ফারিত হল অতীতের দিকে ইঙ্গিতপরায়ণ চেলালের একমাত্র লক্ষ্য রেশমী। সে মনে মনে জপ করতে থাকে-রেশমী, রেশমী, রেশমী। তার পরে কখন ঘুমিয়ে পড়ে।
.
রাম বসু বলে, টুশকি এসেছিস, আর তোর বৃন্দাবনে ফিরে গিয়ে কাজ নেই, আমার কাছে থেকে যা।
সে বলে, কায়েৎ দা, এ কেমন বিচার? লোকে শেষ বয়সটা তীর্থে কাটায়, আর আমি কিনা মাঝবয়সটা তীর্থে কাটিয়ে শেষ বয়সে মরব কলকাতা শহরে!
কেন রে, কালীঘাট, গঙ্গাতীর, এ কি তীর্থ নয়?
অমন কথা কি মুখে আনতে আছে, ছি! এই বলে মাথায় হাত ঠেকিয়ে সে বলে, কার তীর্থ কোন্খানে কে বলতে পারে? গোবিন্দজী যে আমাকে টেনেছেন।
না রে পাগলী, গোবিন্দজী নয়, মোকদা বুড়ি টেনে রেখেছিল তোকে। যেমনি সে মরেছে অমনি টান ছুটে গিয়েছে, ছুটে এসেছিস কলকাতায়।
।টুশকি বলে, সত্যিকার পাপ মনেরও অগোচর। তোমার কথাই বুঝি সত্যি!
তবে আর কি, এখানে থেকে যা। আমারও তো সংসার দেখবার জন্যে একটা লোকের দরকার।
আবার বাঁধবে আমাকে সংসারে? কেন, তোমার লোকের অভাব কি? নরুর বিয়ে দাও, লোকের অভাব দূর হবে।
আরে সেজন্যে তো একটা লোকের দরকার। আমার কি পাত্রী দেখে বেড়াবার সময় আছে!
তোমার কথা কবে ঠেলেছি কায়েৎ দা, কিন্তু তার আগে একবার জোড়ামড় যেতে চাই যে।
কেন রে, সেখানে কেন?
বল কি, জন্মগ্রাম, দেখতে ইচ্ছা যায় না?
অমনি চণ্ডী বক্সীর হুড়োটাও খেতে ইচ্ছা যায়, কি বলিস?
চণ্ডী খুড়ো কি এখনও জীবিত আছেন?
শুধু জীবিত! বেশ বহাল তবিয়তে আছে। দুষ্ট লোক দীর্ঘজীবী হয়, জানিস না?
টুশকি বলে, তা খুড়ো বেঁচে থাকে থাকুক, আমি একবার গাঁয়ে গেলে তার আপত্তি হবে কেন?
আলবৎ হবে। তোদর বিষয়-সম্পত্তি ভোগ করছে, আর তুই গেলে তার আপত্তি হবে না? কি যে বলিস! না, ও মতলব তুই ছেড়ে দে।
তখন টুশকি সাময়িকভাবে পরাজয় স্বীকার করে বলে, না হয় না-ই যাব, কিন্তু তুমি এত সকালে কোথায় চললে, আজ ত তোমাদের ছুটি।
রাম বসু সংক্ষেপে বলে, কলেজ নেই, কিন্তু অন্য একটা কাজ আছে, একবার মানিকতলার দিকে যাব একজন ভদ্রলোকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে।
ফিরতে খুব দেরি ক’র না। তোমার স্বভাব, মনের মতন লোকের দেখা পেলে নাওয়া-খাওয়া ভুলে বসে থাক!
রাম বসু দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে, মনের মতন লোকের দেখা দশ বছরের মধ্যে পাই। নি রে, নাওয়া-খাওয়ার আর ভুল হয় না।
এই বলে সে হাসল। সে হাসিতে টেনে বের করল টুশকির হাসি। কিন্তু দুটি হাসিই বড় স্নান, ওর চেয়ে চোখের জলের উজ্জ্বলতাও বুঝি বেশি।
শীগগির ফিরে আসছি, বলে ছাতা আর চাদর নিয়ে বেরিয়ে পড়ল রামরাম বসু।
জানবাজার সড়ক ধরে খানিকটা পুব দিকে চলে মারাঠা খাল বোজানো বাহার সড়ক নামে নূতন যে রাস্তা তৈরি হয়েছে তাই ধরে বরাবর উত্তরমুখে চলতে শুরু করল রাম বসু। দেখতে পেল রাস্তার ডানদিকে খালের মধ্যে বড় বড় সব নৌকা বাধা; সেগুলো আসছে সুন্দরবন থেকে, জ্বালানী কাঠ, হরিণের চামড়া আর মধুর জালায় ভর্তি। এসব তার চোখে পড়লেও মনটা ছিল অন্য বিষয়ে নিমগ্ন। সে সিদ্ধান্ত করেছিল যে রেশমীর মৃত্যুর মূল কারণ সহমরণ প্রথা। সহমরণ প্রথা এমন নিষ্ঠুর ব্যাপকতা লাভ না করলে রেশমীর জীবন স্বাভাবিক খাতে প্রবাহিত হত। সে ভাবে, রেশমী না হয় অকালে বিধবা হয়েছিল, কিন্তু তাই বলে স্বামীর চিতায় উঠতে বাধ্য হবে কেন? অবশ্য চিতা থেকে সে পালিয়েছিল সত্য, কিন্তু কোথায় তার মনের কোন অগোচরে অগ্নি তার জ্বালাময় দাবির স্বাক্ষর রেখে গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত অগ্নিই তার গ্রাস পুনরায় গ্রহণ করল। কিন্তু কেবল অগ্নিই সক্রিয় আর রেশমী নিষ্ক্রিয় ছিল, একথা আর সে ভাবতে পারে না। রাম বসুর ধারণা হয়েছিল যে অগ্নির দাবিই রেশমীকে প্ররোচিত করেছিল বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিতে। যেদিন সে কাষ্ঠপুত্তলিকাবৎ দাঁড়িয়ে সেই অগ্নিদাহ লক্ষ্য করেছিল, সেইদিনই কথাটা তার মনের মধ্যে ঝলক দিয়ে উঠেছিল। তার পরে দশ বৎসর ধরে সেই নিদারুণ শোক লালিত হয়েছে স্মৃতিতে। স্মৃতি থেকে এসেছে চিন্তায়, চিন্তা থেকে চেষ্টায়-সহমরণ প্রথা উঠিয়ে দিতে হবে, রেশমীর মত আর কেউ যেন চিতায় মরতে না বাধ্য হয়। সে জানে রেশমী আর ফিরবে না, কিন্তু সহমরণের চিতানল দেশ থেকে নিভে গেলে রেশমীর আত্মা শান্তি পাবে—এমনিধারা একটা ধারণা গড়ে উঠেছিল বসুজার মনে। কত পণ্ডিতের কাছে যাতায়াত করেছে মীমাংসার আশায়, কেউ প্রশ্রয় দেয় নি; কেউ খ্রীষ্টান বলে তাড়িয়ে দিয়েছে, বলেছে, তোমার কথা শুনলেও পাপ। শেষ পর্যন্ত সহায় পেল মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারকে। বিদ্যালঙ্কার বলল, এ প্রথা শাস্ত্রানুমোদিত নয়, কিন্তু—ঐ কিন্তুতে এসে সব ঠেকে গিয়েছে। ‘কিন্তু’, ‘যদি’ এরা সব রত্মাকরের অনুচর, সমস্ত শুভ সঙ্কল্পের মোড়ে দাঁড়িয়ে দুঃসাহসী পথিককে লাঠির ঘায়ে ধরাশায়ী করে ফেলে। কিন্তু ধরাশায়ী হওয়ার লোক রাম বসু নয়। এখন চলেছে সে দ্রুতপদে অনেক আশা নিয়ে রামমোহনের কাছে, দেখা যাক তার কাছে ‘কিন্তু’র প্রতিষেধক পাওয়া যায় কিনা।