কথাটির উত্তর দেয় না রাম বসু।
মৃত্যুঞ্জয় বলে, ভায়া, আর নয়, অনেকদূর এসে পড়েছ, এবারে ফেরো।
তখন দুইজন দুই ভিন্ন পথ অবলম্বন করে।
————-
* পাঠক, এটি লেখকের কল্পনা নয়। সেকালে কলকাতার শ্বেতাঙ্গ-সমাজের ইতিহাসে একাধিক strike-এর দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। অবশ্য ধর্মঘট নামটি তখন ব্যবহৃত হত না।
.
৫.২ দশ বছরের কথা
রামরাম বসু বাড়ি ফিরতেই নরু বলে উঠল, বাবা, দেখসে কে এসেছে!
এই ভরসন্ধ্যায় আবার কে এল রে-বলে গৃহান্তরে গিয়ে চমকে ওঠে সে, বলে, একি টুশকি, তুই কখন এলি, কার সঙ্গে এলি, তোর দিদিমা কই রে?
টুশকি হেসে বলে, দাঁড়াও কায়েৎ দা, আগে প্রণাম করে নিই, তার পরে একে একে তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি।
প্রণামাদির পরে দুজনে বসল, রাম বসু বলল, এবারে সব খুলে বল্ তো, আগে বল মোদাবুড়ি কোথায়?
টুশকি চোখ মুছতে মুছতে বলল, গোবিন্দজী তাকে পায়ে ঠাই দিয়েছেন।
বলিস কি রে। এ কতদিনকার কথা?
তা চার-পাঁচ মাস হল বইকি। তখন ভাবলাম, গোবিজীর চরণে ঠাঁই পাব এমন ভাগ্য কি করেছি! ভাবলাম, পাই আর না পাই পা দুখানা জড়িয়ে ধরেই পড়ে থাকব। কিন্তু তার আগে একবার কায়েৎ দাকে, নরুকে আর ন্যাড়াকে শেষ দেখা দেখে আসি।
তা এসেছিস বোন বেশ করেছি। কিন্তু এলি কার সঙ্গে?
গোবিন্দজী সেথো জুটিয়ে দিলেন, নইলে শ্রীধাম বৃন্দাবন থেকে কলকাতায় কি একা আসতে পারি।
তার পরে সে বলে, কিছুদিন হল ভেঙে পড়েছিল দিদিমার শরীর। আর শরীরের কি দোষ বল, দিবারাত্রি ধ্যান-জ্ঞান রেশমী, দিবারাত্রি মুখে রেশমী নাম। নাওয়া নেই খাওয়া নেই, ঐ চিন্তা আর ঐ নাম। আমি বলি, দিদিমা, একবার গোবিন্দজীর নাম কর, রাধাকৃষ্ণর কথা ভাব, মহাপ্রভুকে স্মরণ করতে বললে দিদিমা কি বলে জান? বলে, কেমন করে করব দিদি, ঐ সর্বনাশী যে সব ভুলিয়ে দিল। বলে যে, রাধাকৃষ্ণের নাম করব বলে বসি-ঐ নামটা মুখে বেরিয়ে পড়ে, ঐ মুখ মনে ভেসে ওঠে। তার পরে ডুকরে কেঁদে ওঠে, সর্বনাশী, সর্বনাশী, এমন করে সর্বনাশ করে যেতে হয়!
টুশকি বলে যায়, ভেঙে পড়ল শরীর, অবশেষে নাম জপতে জপতে—বিশ্বাস কর কায়েৎ দাকান পেতে শুনেছি রাধাকৃষ্ণ নাম নয়, রেশমী রেশমী জপতে জপতে গোবিন্দজীর পাদপদ্মে দেহরক্ষা করল দিদিমা।
তার পরে হঠাৎ বলে ওঠে, অন্তিম কালে রেশমী নামে কি সদগতি হবে?
কেন হবে না রে পাগলী! শুনিস নি ভগবানের অসংখ্য নাম, ভালবাসার লোকের নামও যে তাঁর নাম। শোন বোন, অনেক বয়স হল, এখন বুঝেছি এই যে নদী পার হওয়াটাই আসল কথা, কে কোন্ নৌকায় পার হল তাতে কি আসে যায়। বিমঙ্গল ঠাকুর মৃতদেহ আঁকড়ে নদী পার হয়েছিল।
কিন্তু যার ভাগ্যে মৃতদেহটাও জোটে না?
রাম বসু বুঝল, কত গভীর নৈরাশ্য টুশকির ঐ উক্তিতে।
বসুজা বলল, সে চোখ বুজে ঝাঁপ দিক নদীতে, মনে ভক্তি থাকলে নদীর ঢেউ মায়ের কোলের মত দোলাতে দোলাতে তাকে নিয়ে যাবে ওপারে।
রাম বসুর কথা শুনে টুশকি বলে ওঠে, কায়েৎ দা, তোমার খুব পরিবর্তন হয়েছে।
হবে না তো কি! দশ বছর কি কম সময়! তার পরে বলে, যা এখন খেয়ে শো গে। খুব ক্লান্ত হয়েছিস, রাতও হয়েছে অনেক।
.
বিছানায় শুয়ে রাম বসুর নিজের কথাটা মনে পড়ে। ভাবে, হবে না পরিবর্তন, দশ বৎসর কি কম সময়?
সত্যই দশ বৎসর কম সময় নয়, তার উপরে যদি আবার ঘটনার গুরুত্ব চাপে, তবে দশ বৎসর শতাব্দীর ব্যবধান লাভ করে। দশ বৎসর অদৃষ্ট রাম বসুকে ঢেলে সেজেছে—মালমশলা সেই আগেরই, সজ্জাটা নৃতন।
সেদিনের কথা কি সে কখনও ভুলবে? এ জন্যে তো নয়। জন্মান্তরে কি হবে জানে না সে। খুব সম্ভব জন্মান্তরের দিগন্তকে মাঝে মাঝে হঠাৎ-আলোয় চমকে দেবে রেশমীদাহের উষ্কার-শিখা। এখনও চোখ মুদ্রিত করলেই সে দেখতে পায় অসহায় বীরের মত জনের প্রচন্ড প্রচেষ্টা, দেখতে পায় ন্যাড়ার আকুলিবিকুলি, টুশকির মাথা কুটে মরা, আর উদভ্রান্ত জনতার হায় হায় ধনি। সকলে অবাক হয়ে গিয়েছিল সে নিজেও কম অবাক হয় নি—নিজের পুত্তলিকাবৎ স্থাণুতায়। অল্প দুঃখেরই প্রকাশ সম্ভব, মহৎ দুঃখ অপ্রকট। সানুদেশের তুষার গলে, শিখরের তুষার অটল।
রাম বসু ভাবে, ওদের আর কি গেল, কতটুকু ক্ষতি হল ওদের! জনের প্রিয়া গেল, টুশকির ভগ্নী গেল, ন্যাড়ার রেশমীদি গেল—কিন্তু তার নিজের? তার জীবনের সমস্ত আশা, স্বপ্ন, কল্পনা ঘূর্ণমান হয়ে কেন্দ্রীভূত হয়েছিল যে সুমেরুশিখরে, সেই সোনার লঙ্কা যে পুডে নিঃশেষ হয়ে গেল। তার আর থাকল কি? ক্ষতির দুঃসহতা বোঝবার জন্যে থাকল কেবল সে নিজে। রাম বসু অনেক দিন মনে মনে বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখতে চেষ্টা করেছে রেশমীর সঙ্গে তার সম্বন্ধটা। তার মনে হয়েছে যে, সে সম্বন্ধটা কামজ নয়, প্রেমজ নয়, রক্তের বা সমাজের নয়—এ যেন একটা দিব্য অলৌকিক ভাব। এ যেন চাঁদের সঙ্গে সমুদ্রের আকর্ষণ-বিকর্ষণের যোগাযোগ। চাঁদের টানে সমুদ্র উদ্বেল হয়ে ওঠে, জোয়ারের ধাপে ধাপে এগিয়ে চন্দ্রলোকের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়, কিন্তু সে হাত কখনও স্পর্শ করতে পারে না চন্দ্রমাকে। অপ্রাপ্যতার উচ্চাকাশে বসে রসিযে তোলে সমুদ্রের মন রহস্যময় সুধাকর। রেশমী চন্দ্রমা, রাম বসু পারাবার। দশ বৎসর আগে তার গগন ভুবন জীবন চির-অন্ধকারে ডুবিয়ে দিয়ে সে চাঁদ অস্তমিত হয়েছে অগ্নিশিখার দিগন্তে। তার পর থেকে অনুম্বেল নিস্তরঙ্গ একটানা সমুদ্র জনান্তিকে প্রলাপরত, তার ধনি এখন চিন্তার মত নীরব, নিজের কানেই পৌঁছতে চায় না।