অন্ধকার বলেই তো জ্ঞানের আলোর দরকার পণ্ডিত, স্বর্গে পাঠশালা অনাবশ্যক।
ঠিক বলেছ ডাকার কেরী-মৃত্যুঞ্জয় ডক্টর শব্দটাকে ডাক্তার উচ্চারণ করে—কিন্তু সর্বাঙ্গে ক্ষত, ওষুধ লাগাবে কোথায়?
মনের মধ্যে, পণ্ডিত, মনের মধ্যে-ঐ জায়গায় ওষুধ পড়লে তার গুণ সর্বানে ছড়িয়ে পড়বে। এই উদ্দেশ্যেই কলেজ স্থাপন করেছিল ওয়েলেসলি। আবার ক্ষতস্থানের বিবরণ সংগ্রহের জন্যেও ওয়েলেসলি আমার উপর ভারাপণ করেছিল। গঙ্গাসাগরে সন্তানবিসর্জন, সতীদাহ প্রথা প্রভৃতির প্রকৃত বিবরণ সংগ্রহের জন্য আমি আদি হয়েছিলাম। চারজন সহকর্মী নিয়ে ১৮০৪ সালে কলকাতার ত্রিশ মাইলের পরিধিতে সন্ধান করে আমার ধারণা হয় যে, বছরে প্রায় পঁচিশ হাজার প্রাণীকে হত্যা করা এয় এইভাবে। তার পরে আমার অনুরোধে তোমারই শাস্ত্র থেকে প্রমাণ করে দেখিয়েছি যে, সন্তানবিসর্জন, সহমরণ প্রভৃতি শাস্ত্রানুমোদিত নয়।
রামনাথ বাচস্পতি একান্তে বসে নিম্নস্বরে বলে, আরম্ভ হল পাত্রীগিরি! শানুমোদিত নয়! কত শাস্ত্রই না পড়েছ!
বিদ্যালঙ্কার বলে, কিন্তু তাতে অবস্থার উন্নতি হল কই? তার পরেও তো পাঁচ ছ বছর অতিবাহিত হল!
হত না অতিবাহিত, জোরের সঙ্গে বলে কেরী, ওয়েলেসলি আমাদের রিপোর্ট আর তোমাদের বিধান পেয়ে স্থির করেছিল যে, আইন প্রণয়ন করে নিষিদ্ধ করবে সতীদাহ। সমস্ত প্রস্তুত, এমন সময়ে কাজে ইস্তফা দিয়ে লাটসাহেব চলে গেল বিলাতে।
তাই তো বলছি ডাক্তার কেরী–যথা পূর্বং তথা পরং। এখনও অবাধে চলছে সতীদাহ দেশের যত্রতত্র।
ব্যাকুলভাবে রাম বসু বলে ওঠে, এর কি কোন প্রতিকার নেই? তুমিই তো এইমাত্র বললে চরিত্রের মধ্যে যে রোগের মূল নিহিত, তা দুঃসাধ্য। দুঃসাধ্য, কিন্তু অসাধ্য নয়।
কে বলল অসাধ্য মুন্সী, তবে কঠিন। কিন্তু একথাও বলছি, তোমার আমার জীবনকালেই অবসান ঘটবে এই পাশবিক সংস্কারের। ওষুধ পড়তে শুরু করেছে।
কি ওষুধ? ইংরেজী শিক্ষা। আবার স্বগতভাবে বলে রামনাথ বাচস্পতি, ব্যাধির চেয়ে ঔষধ উৎকটতর।
কেরীর অভয়দানে রাম বসু যে উৎসাহ পেল এমন মনে হল না, বিষমুখে বসে রইল সে।
.
কলেজে অধ্যায়, কাজেই সকলে বাড়ি রওনা হয়।
রাম বসু বলে, বিদ্যালঙ্কার, চল তোমাকে একটু এগিয়ে দিই।
বেশ তো চল, দুটো কথা বলতে বলতে যাওয়া যাবে।
লালবাজার দিয়ে এগিয়ে গিয়ে ওরা একটা সরু গলিপথে চলে, আগে মৃত্যুঞ্জয় পিছনে রাম বসু। রাম বসু লক্ষ্য করে বিদ্যালঙ্কারের চলবার ভঙ্গীটি। বাঁ পাখানা তার কিঞ্চিৎ বিকল, তাই লাঠি আর ডান পার জোরে বাঁ পা সুদ্ধ দেহটাকে হেঁচকা টান মেরে চালিয়ে নিয়ে যায় সে। রাম বসু দেখে, মেদবহুল দেহ সাদা আঙরাখার খাজে খাঁজে নিবিষ্ট; কাঁধের উপরে বিষ্ণুপুরী তসরের চাদর। মাথার চারপাশ কামানো, মাঝখানে গুচ্ছবদ্ধ চুল। তখন তার মনে পড়ে প্রশস্ত গড়ানে কপালে লিপ্ত আছে প্রাতঃকালের সন্ধ্যাজিকের চন্দনের হপ, সেই কপালের নীচে কাঁচা-পাকা ভুরুর তলায় জ্বলন্ত টিকার মত দুটি চোখ, জ্ঞানের একটুখানি হাওয়া লাগতেই উজ্জ্বলতর হয়ে ওঠে—আর দুই চোখের মাঝখানে বিন্ধ্যপর্বতের ব্যবধান সৃষ্টি করেছে মস্ত একটা শুকনাসা। প্রকাণ্ড চিবুক অদৃষ্টের উদ্যত ঘুষির মত সংসারকে যেন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আহ্বান করছে। রাম বসু মনে মনে ভাবে, আশ্চর্য এই লোকটি! তখনই মনে পড়ে এ বিস্ময়বোধ কেরীর মনেও জেগেছে। কেরী অনেকদিন বলেছে যে, পণ্ডিতকে দেখলে, তার পাণ্ডিত্য, বিপুল দেহ, স্কুলষ্টি, রাশভারী চালচলন দেখলে বিখ্যাত ডাক্তার জনসনকে মনে পড়ে যায়, যাকে বাল্যকালে একাধিকবার দেখেছে কেরী। কেরী বলত যে, ডাক্তার জনসনকে লোকে নিজেদের মধ্যে সশ্রদ্ধভাবে ‘ভালুক’ বলে অভিহিত করত। আর পণ্ডিত হচ্ছে হস্তী, একেবারে রাজহস্তী। রাম বস আবার ভাবে, আশ্চর্য এই লোকটি!
ততক্ষণে তারা চিৎপুর রোডে পড়ে পাশাপাশি চলতে শুরু করে।
হঠাৎ রাম বসু জিজ্ঞাসা করে, বিদ্যালঙ্কার, সহমরণ সম্বন্ধে শাস্ত্রীয় বিধান কি?
বিদ্যালঙ্কার বলে, দেখ বসুজা, শাস্ত্রে সবরকম কথাই আছে। ভিন্ন ভিন্ন যুগ অভিপ্রায় অনুসারে মনোমত উক্তি বেছে নেয়।
তার পরে সে বলে, এতদিন যুগ ছিল সতীদাহ-সমর্থক, এবারে যে যুগ পড়তে চলেছে তাতে বদল হবে ব্যাখ্যার, সতীদাহ আর চলবে না।
আগ্রহভরে জিজ্ঞাসা করে বসুজা, কিন্তু কবে বিদ্যালঙ্কার-কবে?
যুগের হাওয়া প্রবল হয়ে উঠলেই।
তুমি তো হিন্দুশাস্ত্র মহন করেছ, গোটা সুবে বাংলা জানে তোমাকে, মানে তোমাকে। ওঠাও হাওয়া।
না ভায়া, যার যা কাজ নয় তাকে দিয়ে তা হবার নয়। আমি জ্ঞানের কথা জানি, তা বলতে পারি। কিন্তু শুধু জ্ঞানে হাওয়া ওঠানো যায় না, তার জন্যে চাই শক্তি, চাই উদ্যম, চাই যুগযন্ত্রকে চালনা করবার কৌশল।
কোথায় পাব তেমন নোক? জিজ্ঞাসা করে বসুজা।
যাও তবে মানিকতলায়, খোঁজ করে দেখ দেওয়ানজী কলকাতায় আছেন কি না–ঐ রকম লোকের উপরেই যুগের মতিগতি নির্ভর করছে।
বেশ, তাই যাব, আগামীকাল রবিবার। তার পরে কতকটা স্বগতভাবেই যেন রাম বসু বলে ওঠে, জ্ঞানের কথাও শুনলাম, শক্তির কথাও শুনলাম—কিন্তু হৃদয়ের কথা?
স্বগত উক্তির স্বগত উত্তর দেয় মৃত্যুঞ্জয়, বলে—হৃদয়ের কথা হৃদয় জানে, অপরে কি জানবে!