ছোকরার দল অনেকদিন থেকেই ভিতরে ভিতরে সচেতন হয়ে উঠেছিল, কিন্তু প্রশ্রয়ের অভাবে সেটা প্রকাশ পায় নি।
প্রশ্রয় দেবে কে? এ যে রাজার শাসন।
পণ্ডিত, রাজার উপরেও রাজা আছে। এখানে সবসময় কর্তা গভর্নর জেনারেল, কিন্তু বিলাতের বোর্ড অব ডিরেকটরস তারও উপরে।
তাতে কি হল?
হল এই যে, কলেজের জন্য প্রভূত ব্যয় হচ্ছে দেখে বোর্ড এটা উঠিয়ে দেবার মতলবে আছে। ওয়েলেসলির মত জবরদস্ত লোক না থাকলে কোনদিন উঠিয়ে দিত এই কলেজ। এখানকার বড়লাট তেমন তেজস্বী নয়, বিলাতের বোর্ড আবার কলেজ উঠিয়ে দেবার উপায় সন্ধান করছে।
তার সঙ্গে এই ধর্মঘটের সম্বন্ধটা তো বুঝতে পারছি না।
ধৈর্য অবলম্বন কর পণ্ডিত, বুঝিয়ে দিচ্ছি। এখানকার লাট কাউন্সিলের মধ্যেই কোন কোন মেম্বার বোর্ডের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন। এখন তাদের ইঙ্গিতেই এই ধর্মঘট।
কেন কি! একটা অশান্তি হক, গোলযোগ হক, তাহলে কলেজ উঠিয়ে দেবার পথ সুগম হয়।
ছাত্রেরা কি এত কথা জানে?
স্পষ্ট জানে না, আভাসে জানে, ইঙ্গিতে জানে যে, গোলমাল করলে প্রভুরা অসন্তুষ্ট হবে না।
কিন্তু তাদের কি লাভ এতে?
লাভ ষোল আনা। এখানকার কলেজের ঘরে পড়াশুনার সুবিধা হচ্ছে না, আলো হাওয়ার অভাব ইত্যাদির ছুতো তুলে তারা আবার রাণীমুদিনীর গলি, ম্যাঙ্গো লেনে বাড়িভাড়া করে স্বাধীনভাবে থাকতে চায়। তাদের লাভ যথেচ্ছাচার, বোর্ডের লাভ কলেজ উঠে গেলে বিস্তর খরচা বাঁচে। তাই তো বলছিলাম লাভ যোল আনা।
আর ষোল আনা ক্ষতি আমাদের। বাঙালীর ছেলের চাকরি গেলে আর থাকে কি।
না মুন্সী, ক্ষতি সমস্ত দেশের, ক্ষতি ইংরেজ-শাসনের। আর বাঙালীর ছেলের কথা বলছ? তাদের থাকে কি জিজ্ঞাসা করছ? এখানে আমরা মিলিত হয়ে আজ দশ বছর ধরে বাংলা ভাষার ব্যাকরণ অভিধানগ্রন্থ রচনা করে যে ভিত্তি পত্তন করেছি—একদিন সেই মহাসৌধ হবে ভবিষ্যতের বাঙালীর ছেলের শ্রেষ্ঠ আশ্রয়; তা ঝড়ে টলবে না, ভূমিকম্পে নড়বে না, আগুনে পুড়বে না, মহামন্তরেও বিচলিত হবে না। বাঙালীর ছেলের এই লাভ। এ লাভের চেয়ে বড় লাভ আর কি হতে পারে জানি না।
বলতে বলতে উৎসাহে দাঁড়িয়ে উঠে কেরী ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে থাকে।
লোকমুখের শব্দ, বিদেশী শব্দ, সংস্কৃত শব্দ তিনে মিলিয়ে সেই সৌধের গাঁথুনি চলেছে। সংস্কৃত এর ভিত্তি, লোকমুখের শব্দ এর হাক আর বিদেশী শব্দ চুন-সুরকি। আর এর কারিগর হচ্ছে খ্রীষ্টান, মুসলমান, হিন্দু। দিনে দিনে দিব্য সৌধ উঠছে আকাশের দিকে। তুচ্ছ কিছু ক্ষুদ্র কিছু গ্রাম্য কিছু অশোভন অকিঞ্চিৎকর কিছু থাকবে না ভাষায়। অবশেষে একদিন এর স্বর্ণময় চুড়া রবির আলোকে ভাস্বর হয়ে উঠবে। সেদিন দেশ বিদেশের লোকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকবে, ভাববে কোন্ সে ময়দানবের অক্ষয় কীর্তি এই অঞ্চয় মন্দির।
এবারে সে রামরাম বসুর কাছে এসে বলে ওঠে, মুন্সী, এই থাকবে বাঙালীর ছেলের।
তার পরে বিদ্যালঙ্কারের কাছে এসে বলে ওঠে, যতই দিন যাচ্ছে সংস্কৃত ভাষার মহিমা বুঝতে পারছি, তুলনা নেই এর তুলনা নেই, ডিভাইন, সিমপ্লি ডিভাই।
.
পরদিন আবার অধ্যাপক, পণ্ডিত ও শিক্ষকগণ যথাসময়ে কলেজ হলে মিলিত হয়, কিন্তু ছাত্রগণ দেখা দেয় না।
রাম বসু বলে, আজও দেখছি ছাত্রেরা আমাদের দুটি দিল।
মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার বলে, তা যেন দিল, কিন্তু পাখানগুলো গেল কোথায়? দোতলায় আছে বলে তো মনে হচ্ছে না, সমস্ত নীরব নিঝুম।
কেরী বলে, সব ঘুমোচ্ছ।
ঘুমোচ্ছ! এখন! বিস্মিত হয় বিদ্যালঙ্কার।
কেরী বলে, ঘুমোবে না? কাল সারারাত হুল্লোড় করেছে।
কেমন? শুধায় বিদ্যালঙ্কার।
কেরী বলে, কাল রাত্রে ইয়ং রাস্কেলরা মদ আর মেয়েমানুষ নিয়ে এমন তুমুল। কাজ করে যে, শেষ পর্যন্ত দারোয়ানরা গিয়ে আমাকে ডেকে আনে।
কেরীর বাস চৌত্রিশ নম্বর বউবাজার স্ত্রীটে।
আমি এসে দেখি দোতলায় নারকীয় কাণ্ড চলছে। আমাকে দেখেও লজ্জা হল না ওদের। আমি বললাম, এমন কাণ্ড করলে তোমাদের তাড়িয়ে দেওয়া হবে এ বাড়ি থেকে। তাই শুনে একজন বলে উঠল, আমরাও তো তাই চাই। কেন আমাদের এখানে রেখেছ? দাও তাড়িয়ে, আমরা প্রেম ব্যানাজীর বাড়ি ঠিক করে রেখেছি।
তখন আমি ঐ গির্জাটা দেখিয়ে বললাম, গির্জার এত কাছে থেকেও তোমাদের এই রকম নির্লজ্জ ব্যবহার! তা শুনে একজন কি বলল জান? বলল, নীয়ারেস্ট টু চার্চ ইজ ফার্দেস্ট ফ্রম হেভেন। নির্লজ্জ যত সব!
এই পর্যন্ত বলে কেরী থামে।
তখন মৃত্যুঞ্জয় বলে, তবে এখন ঘুমোবে তাতে আর বিস্ময়ের কি আছে!
তখন কেরী বলল, কালকে আমি লাট কাউন্সিলের একজন মেম্বারকে সব খুলে বলেছি। সে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে, কাউন্সিলে ব্যাপারটা আজ তুলবে। তার পরে কেরী বলে, আশা করি আপাতত সব মিটে যাবে। কিন্তু রোগটার মূল খুব গভীরে।
রামরাম বসু বলে, যে রোগের মূল স্বভাবে তার নিরাময় সহজ, কিন্তু যে রোগের মূল চরিত্রে তা দুঃসাধ্য।
কথাটা ঠিক, বলে কেরী।
তার পরে প্রসঙ্গত মনস্তত্ত্ব, ধর্মতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব এসে পড়ে।
কেরী বলে, কুসংস্কার সব দেশেই আছে, আমাদের দেশে আছে, তোমাদের দেশেও আছে। এই কলেজের একটা উদ্দেশ্য, সেই সব কুসংস্কার দূরীকরণ।
মৃত্যুঞ্জয় বলে, কিন্তু এ যে রোজাকে ভূতে পেয়ে বসল! এখানকার ছাত্ররা যদি এমন দুবৃত্ত হয়ে ওঠে, তবে তো চারদিক অন্ধকার!