গানের তাৎপর্যের সঙ্গে তাদের শিক্ষানবিশী জীবনের তাৎপর্য মিলে গেল দেখে বন্ধুরা মহা কলরবে হেসে উঠল।
কিন্তু গানের তাৎপর্য দিল জনকে চটিযে, সে পা-দানির উপর দাঁড়িয়ে উঠে যুবকদের ইঙ্গিতে শাসাল। এতে ফল হল ঠিক বিপরীত। তাদের গান তো থামলই না, বরঞ্চ ভিন্নতর খাতে প্রবাহিত হল, যার এক কূলে ব্যঙ্গ, অন্য কূলে প্রচ্ছন্ন লালসা।
একজন যুবক যথোচিত ভঙ্গী ও মুদ্রা করে শুরু করল–
“O lovely Sue,
How sweet art thou,
Than sugar thou art sweeter,
Thou dost as far
Excel sugar
As sugar does saltpetre.”…
এই অপ্রত্যাশিত ও সময়োচিত কাব্যফুর্তিতে বড় হাসির হররা পড়ে গেল সকলে সমস্বরে গেয়ে উঠল–As sugar does salpetre!’
তখন জন আস্ত জনবুল-মূর্তি ধারণ করে ইঙ্গিতে কিল ঘুষি ছুঁড়তে লাগল। আর ওদিক থেকে অপরপক্ষ ইশারায় চুম্বন ছুঁড়ে দেওয়া শুরু করল—সঙ্গে সঙ্গে,
“One for the master. one for the dame,
One for the lame man who lives by the lane.”
কেটি ও লিজা অপ্রস্তৃত হয়ে গিয়েছিল, তারা নিতান্ত অপরাধীর মত চুপ করে বসে রইল। কিন্তু মনটা চুপ করে ছিল না। কেটি ও লিজা দুজনেই মনে মনে যাবতীয় দায়িত্ব পরস্পরের ও জনের ঘাড়ে চাপাচ্ছিল, যুবকদের কেউ একবারের জন্যেও দায়ী করল না। এরকম না হলে আর রমণীকে বিশ্বাসহন্ত্রী ইভের বংশধারিণী বলেছে কেন?
ইশারায় চুম্বনবৃষ্টি কমাবার উদ্দেশ্যে জন এক পাটি জুতো খুলে নিয়ে দোতলা লক্ষ্য করে ছুঁড়ল—আর তার প্রত্যুত্তরে গোটা দুই বিয়ারের বোতল এসে পড়ল গাড়ির আশেপাশে। তখন কোচম্যান সমাধানের ভার নিজের হাতে তুলে নিয়ে ঘোড়ার পিঠে চাবুক মারল। গাড়ি জোরে ছুটল। অপস্রিয়মাণ গাড়ির আরোহীদের কানে যুবকদের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর প্রবেশ করল–
“Return again fair Lesley.
Return to Loll Digie!
That we may brag wc hae a ass,
There’s none again sae bonnie.”
রাগে অপমানে জন ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল, সে বসে বসে গজরাতে লাগল। বালক ফেলিক্সের কাছে সবটাই একটা মস্ত তামাসা বলে মনে হল। কেটি ও লিজাও ক্ষুব্ধ, জনের প্রতি সমবেদনাপরায়ণ ও কৃতজ্ঞ। কিন্তু…..কিন্তু তৎসত্ত্বেও অস্তিত্বের গভীরতম কেন্দ্রে কেমন একটুখানি তীব্র সুখের মতন অভিজ্ঞতা তারা অনুভব করছিল। যুবকদের আচরণ অবশ্যই অভদ্র, কিন্তু তার মূলে তাদের দীর্ঘ উপবাসজনিত বুভুক্ষা; বুভুক্ষুর আর্তনাদে বিরক্ত হলে চলবে কেন, তাদের ক্ষুধার মূল্য দাও। কিসের ক্ষুধা? নারীর। কে সে নারী?
কেটি ভাবছিল, আর যেই হক, ভিজা নয়। লিজাও ঠিক ঐ কথাই ভাবছিল, আর যেই হক, কেটি নয়।
নারীসমাজে নারী নির্বান্ধব, কারণ সংসারের যাবতীয় নারী তার প্রতিদ্বন্দিনী-হক সে কন্যা, হক সে মাতা, হক সে শ্বশু! পুরুষসমাজেও সে নির্বান্ধব, কারণ সে কখনও পুরুষকে বন্ধুরূপে অর্থাৎ সমানে সমানে পাওয়ার কল্পনায় তৃপ্তি পায় না। আলিঙ্গনাবদ্ধ নাকে পুরুষ জিজ্ঞাসা করে-‘তুমি আমার?’ নারীজীবনের গভীরতম অভিজ্ঞতার প্রেরণায় সে বলে-‘আমি তোমার।‘
এতক্ষণ একদল ছোকরা ট্যাঙ্ক স্কোয়ারের মধ্যে দাঁড়িয়ে নিরাপদ দূরত্ব রক্ষা করে সাহেবদের কান্ড দেখছিল। এবারে পলায়নপর গাড়িখানা খানিকটা দূরে যেতেই তারা উচ্চৈঃস্বরে ছড়াকাটা শুরু করল।
হাতীপর হাওদা, ঘোড়াপর জিন,
জলদি যাও জলদি যাও, ওয়ারেন আস্তিন।
গাড়িখানা কসাইটোলা-চিৎপুরের মোড়ে পৌঁছতেই লিজা বলল, জন, এবার ফেরা যাক।
জন কোচম্যানকে সেইরকম হুকুম করলে গাড়ি কসাইটোলা ধরে চলল চৌরঙ্গীর দিকে। গাড়ি Davies Daintie দোকানের কাছে আসতেই লিজা বলল—কোচম্যান, রোখো।
গাড়ি থামলে সে বলল, কিছু কেকের অর্ডার দিয়ে যেতে হবে। নাম না মিস প্ল্যাকেট, দোকানটা দেখে যাও, পরে কাজে লাগবে।
তখন কেটি ও ফেলিক্স লিজাকে অনুসরণ করে নেমে দোকানে ঢুকল।
অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও জন নামল না, সে যেমন বসে ছিল তেমনি চুপ করে বসে রইল।
.
১.১০ দি অ্যাভিনিউ
কেরীর গাড়ি কসাইটোলার মোডে পৌঁছতেই কেরী বিস্ময়ে বলে উঠল–এ কি!
টমাস বলল, পরশুদিন দুজন ফিরিঙ্গির ফাঁসি হয়েছিল, তাদেরই দেহ ঝুলছে।
এমনভাবে কদিন থাকবে?
আরও চার-পাঁচ দিন থাকবে, তার পর পচতে শুরু করে দুর্গন্ধ ছাড়তে শুরু করলেই সরিয়ে ফেলা হবে।
কেরী অনেকটা যেন আপন মনেই বলল, এভাবে প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়া মানবোচিত কার্য নয়।
অপ্রত্যাশিত উম্মায় মিসেস কেরী চীৎকার করে বলল—কি এমন অন্যায়টা হয়েছে? তারা খুন জখম করবে প্রকাশ্যে, আর তাদের ফাঁসি দেওয়া হবে গোপনে! তাহলে লোকশিক্ষা হবে কি উপায়ে?
কেরী বলল,—দু পক্ষেই অনেক কিছু বলবার আছে সত্য, কিন্তু এ খ্রীষ্টানোচিত নয়।
রাখ তোমার ধর্মোপদেশ! ডাঃ টমাস, এ খুব স্বাস্থ্যকর প্রথা। এর পর ফাঁসি হবে খবর শুনলে আমাকে জানিও, আমি অবশ্য দেখতে আসব।
গাড়ি অ্যাভিনিউ সড়ক ধরে চলেছে। দুদিকে বড় বড় বাড়ি, অধিকাংশই দোতলা, একতলার সংখ্যাও কম নয়। অধিকাংশ বাড়িই শ্বেতাঙ্গগণের।
কেরী বলল, রাস্তাটাকে ফ্যাশনেবল পাড়া বলে মনে হয়।
টমাস বলল—হাঁ, চৌরঙ্গীর পরে এটা শৌখিন পাড়া। অবশ্য গার্ডেনরীচ ও আলিপুরের কথা আলাদা। ও দুটো হচ্ছে কাঞ্চন-কৌলীন্যের স্বর্গ।