কেরী জিজ্ঞাসা করে, উত্তরদিকের ঐ লম্বা বাড়িটা কি?
ওটার নাম রাইটার্স বিল্ডিং। নীচের তলায় কোম্পানির আপিস। দোতলায় নবাগন্তুক রাইটারদের বাসস্থান। আর ঐ পুবদিকে দেখা যাচ্ছে—ওন্ড মিশন চার্চ।
ওটাই কি শহরের সবচেয়ে পুরনো গির্জা?
সবচেয়ে পুরনো গির্জাটা মুগীহাটা নামে এক জায়গায়। সেটাকে বলে আর্মেনিয়ান গীর্জা। আর একটা পুরনো গির্জা ছিল রাইটার্স বিল্ডিঙের ঐ পশ্চিম-উত্তর কোণে। নাম ছিল সেন্ট অ্যানস চার্চ। এ পাড়ায় ওটাই ছিল একমাত্র গির্জা—কেল্লার ঠিক সামনেই।
সেটা গেল কোথায়?
সিরাজদ্দৌল্লা যখন কলকাতা আক্রমণ করে তখন কামানের গোলায় ভেঙে যায়, অনেককাল ভাঙা অবস্থায় পড়ে ছিল, তার পর সরিয়ে ফেলে জায়গাটা পরিষ্কার করা হয়েছে।
আর ওটা?
ওটা সেন্ট অ্যান্ড্রুজ চার্চ, এই গত বছর মাত্র তৈরি শেষ হয়েছে।
তার আগে ওখানে কি ছিল?
ওখানে ছিল মেয়রের আপিস আর আদালত, ঐ আদালতেই মহারাজা নন্দকুমারের বিচার হয়েছিল।
কেরী বলল, দেখ টমাস, প্রভু খৃষ্টের কি মহিমা, আদালতের উপরে উঠল গির্জার চুড়া।
টমাস বলল, রাইটার্স বিল্ডিঙের উত্তরে একটা বড় বাড়িতে থাকত লর্ড ক্লাইভ, সেটা এখনও খালি পড়ে আছে। তারই কাছে ছিল পুরনো থিয়েটার আর সার ফিলিপ ফ্রান্সিসের প্রথম বাসস্থান। যাবে ওদিকে?
কেরী বলল, আজ আর যাব না, চল ফেরা যাক—মিসেস কেরী অনেকক্ষণ একলা আছে।
তখন তিনজনে ওল্ড কোর্ট হাউস স্ট্রীট পেরিয়ে এসে রোপওয়াকের মোড়ে গাড়িখানা দেখতে পেল। গাড়িতে উঠলে মিসেস কেরী স্বামীকে বলল-তবু ভাল যে ফিরেছ। এত কি দেখবার ছিল?
প্রভুর মহিমা দেখছিলাম, চারদিকে গির্জা উঠছে।
প্রভুর মহিমা গাড়িতে বসেও দেখতে পারতে। ভবিষ্যতে যখন প্রভুর মহিমা দেখতে বেরুবে আমাকে বাড়িতে রেখে বেরিও।
গাড়ি চলল।
টমাস বলল-ডানদিকে ছিল পুরনো জেলখানা, এখন উঠে গিয়েছে টালির নালার কাছে।
কেরী শুধাল, এ রাস্তাটার নাম কি?
এটা দি অ্যাভিনিউ, সবচেয়ে পুরনো রাস্তা। কেল্লার গেট থেকে বেরিয়ে বরাবর সিধে চলে গিয়েছে বৈঠকখানার বড় বটগাছটা পর্যন্ত, তার নীচেই বিখ্যাত মারহাট্টা ডিচ। তার পরেই আরম্ভ হল-বাদা—মানে—মার্শল্যান্ড।
বাঁয়ে চিৎপুর রোড, ডাইনে কসাইটোলা রেখে গাড়ি চলে দি অ্যাভিনিউ ধরে।
.
১.০৯ বিয়ার বোতলের লড়াই
জন স্মিথদের গাড়ি গঙ্গার ধার দিয়ে ঘুরে নৃতন কেল্লা ও এপ্ল্যানেড হয়ে যখন সেন্ট জন গির্জার কাছে পৌঁছল তখন তারা দেখল যে, সেখানে কেরীদের গাড়ি নেই। জন ভেবেছিল এখানে কেরীদের পাবে, আর একসঙ্গে ফিরবে। তখন দু-একজন লোককে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানল যে, একখানা গাড়ি অনেকক্ষণ আগে এসেছিল বটে, কিন্তু কিছুক্ষণ হল চলে গিয়েছে। শুনে জন কোচম্যানকে হুকুম করল পুরনো কেল্লা হয়ে অ্যাভিনিউ-র দিকে চলতে।
গাড়িখানা যখন লালদিঘির উত্তরদিকে এসে পৌঁছেছে তখন গাড়ির আরোহীরা দেখতে পেল, রাইটার্স বিল্ডিঙের দোতলায় কয়েকজন শ্বেতাঙ্গ যুবক রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে পথের লোকচলাচল দেখছে।
জন কেটির উদ্দেশে বলল, এরা সব বাচ্চা নবাব।
কেটি বলল, তার মানে?
কোম্পানির রাইটার, সবে ইংল্যান্ড থেকে এসে পৌঁছেছে। এখনও এদের নবাবীর ট্রেনিং সম্পূর্ণ হয় নি, হলেই পুরোদস্তুর নবাব হয়ে দেশ শাসন শুরু করে দেবে।
তার পর নিজের মনেই যেন আক্ষেপ করে বলল, এদের আচরণের ফলে এ দেশে ইংল্যান্ডের সুনাম ক্ষুন্ন হচ্ছে।
কেটি শুধাল—এরা এখানে কেন?
দোতলায় এদের বাসস্থান, নীচের তলায় অফিস।
কেটি বলল, এখনও রাত-পোশাক ছাড়ে নি দেখছি।
তা না হলে আর নবাব বলছি কেন! ওরা এই পোশাকেই আপিসে যাবে, পোশাক বদলাবে ডিনারের আগে। ওদের কাছে ওটাই হচ্ছে গিয়ে দিবসের শ্রেষ্ঠ কর্তব্য।
ইতিমধ্যে শ্বেতাঙ্গ যুবকগণ গাড়ির আরোহীদের দেখতে পেল। প্রথমে এ ওকে ইশারায় গাড়িখানা দেখাল, তার পর সকলে একযোগে উল্লাসের হল্লা করে উঠল। সে রকম হল্লা কুড়ির নীচে ও পঁচিশের উপর কারও পক্ষে করা সম্ভব নয়। তাদের উল্লাসের যথেষ্ট কারণ ছিল। শ্বেতাঙ্গিনী দুর্ভিক্ষের বাজারে একসঙ্গে দুটি শ্বেতাঙ্গিনী সুন্দরীর অকস্মাৎ একবারে বাড়ির দরজায় আবির্ভাবে খুশি হয়ে না ওঠে এমন যুবকের অস্তিত্ব ইংলিশ চ্যানেলের পশ্চিমদিককার দ্বীপটিতে সম্ভব নয়। সতীর্থদের হল্লায় আরও জনকয়েক ঘর থেকে বেরিয়ে এল—এবারে সংখ্যা হল পনেরোর কাছাকাছি। কেটি ও লিজার উদ্দেশে চীকার করে উঠল ‘সুইটি’, কেউ চীৎকার করে বলল ‘ডারলিং’।
কেটি ও লিজা মনে মনে কৌতুক ও কৌতূহল অনুভব করল—জনেরও মন্দ লাগছিল।
কেটি ভাবছিল, তারা দুটি যুবতী পাশাপাশি থাকলেও যুবকমন সৌন্দর্যের অর্ঘ্য নিবেদন করে তারই উদ্দেশে। অবশ্য লিজাও নীরবে ঠিক ঐ কথাই ভাবছিল-ভাবছিল, কেটি নিতান্তই উপলক্ষ্য, আসল লক্ষ্য সে নিজে।
এমন সময় একটি যুবক ইশারা ও হাসির আশ্রয় ছেড়ে কবিতার আশ্রয় গ্রহণ করল, সে গেয়ে উঠল
“There’s no lady in the land
Half so sweet as Sally;
She is the darling of my heart,
And she lives in our alley.”
বন্ধুরা বিপুল হাস্যে তাকে সমর্থন জানাল, তখন সে আবার গাইল–
“But when my seven long years are out,
O then I’ll marry Sally.
O then we’ll wed, and then we’ll bed,
But not in our alley.”