কেরী কৌতূহল বোধ করল, শুধাল, হঠাৎ পালাতে গেলে কেন? লোকটা কি রূঢ় ব্যবহার করত?
না না, এদেশী লোকের সঙ্গে ওয়ারেন হেস্টিংস সর্বদা মিষ্ট ব্যবহার করত। কিন্তু কি জানেন ডাঃ কেরী, বৃদ্ধ চাণক্য রাজপুরুষ থেকে শত হস্ত দূরে থাকতে উপদেশ দিয়েছেন। কোন রাজপুরুষ যদি আজ বলে বসে, বসু, তোমার মুখটি বেশ সুন্দর, তখনই ঘরে গিয়ে মাথা নেড়া করে মুখটা যথাসাধ্য বীভৎস করে তোলবার চেষ্টা করব।
তার কথায় কেরী ও টমাস দুজনে হেসে উঠল। হাসলে কেরীর উপরের পাটিতে দুটি অধভগ্ন দাঁত দেখা যায়।
আর সার ফিলিপকে? জিজ্ঞাসা করে কেরী।
আদালতে বিচারের সময়ে তাকে দেখবার সুযোগ পেয়েছিলাম।
তিনি কি ছিলেন, জজ না কৌঁসুলী?
ও দুয়ের কোনটাই নয়। আসামী।
আসামী! অত বড়লোক! বিস্ময় প্রকাশ করে কেরী। কি অপরাধ?
সেসব কথা আপনার মত ধর্মপ্রাণ লোকের শুনে কাজ নেই।
টমাস সব কথাই জানত, সে মুচকে হাসল।
এই যে অন্ধকূপের কাছে এসে পড়েছি—রাম বসু কেরীব মনোযোগ সেদিকে আকর্ষণ করল।
ইতিহাস-কুখ্যাত অন্ধকূপ গৃহ এখন পরিত্যক্ত ও জীর্ণ। দরজা ঠেলে প্রবেশ করতেই একটা ভ্যাপসা গন্ধ তিনজনের নাকে গেল—তার পরেই গোটা দুই বাদুড় পাখা ফড়ফড় করে উড়ে চলে গেল মাথার উপর দিয়ে বাইরের দিকে। চোখ অন্ধকারে অভ্যস্ত হয়ে এলে তিনজনে দেখল এক কোণে পাকারে পড়ে রয়েছে চুন-সুরকি, কতকগুলো ভাঙা লোহা-লক্কড়।
টমাস বলল, ঘরটা এখন গুদামে পরিণত হয়েছে। ঐ গরাদে-দেওয়া উঁচু জানলা দিয়ে নবাবের সেপাই বন্দীদের জল দিয়েছিল।
এই বলে জানলাটার দিকে তাকিয়েই রাম বসু বলল-ইস, সর্বনাশ! আসুন, বাইরে আসুন।
এই বলে কেরীকে হাত ধরে টেনে বাইরে নিয়ে এল-সঙ্গে সঙ্গে টমাসও বাইরে এল।
কি হল?
প্রকাণ্ড মৌচাক। আমাদের সাড়া পেয়ে গুনগুন শুরু করেছে—তাড়া করলে আর রক্ষা নেই, দ্বিতীয় অন্ধকূপ হত্যা ঘটিয়ে ছাড়বে।
রাম বসু বলল, তার চেয়ে আসুন বাইরে যেতে যেতে পুরনো কেল্লার ইতিহাস যতটুকু জানি বলি।
এই শতাব্দীর গোড়ার দিকে এই কেল্লার পত্তন হয়। সমস্তটাই ইটের তৈরী। একদিকে ঐ দিঘি, আর একদিকে গঙ্গা-যদিচ এখন গঙ্গাকে ঠেলে অনেকটা দূরে সরিয়ে দিয়ে সে জায়গায় রাস্তাঘাট আর বাড়ি তৈরি হয়েছে। তখনকার দিনে কোম্পানির যাবতীয় অফিস, গুদাম, ফ্যাক্টরি আর কেরানীদের থাকবার জায়গা এর মধ্যেই ছিল। আর খোদ গভর্নর সাহেবও এখানে থাকতেন, যদিচ নামে মাত্র।
কেন, নামে মাত্র কেন?
কার্যত তিনি কেল্লার বাইরে দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের বড় বাড়িটায় থাকতেন, এখন সেখানে কাস্টম বিভাগের আপিস।
সে আবার শুরু করল—ডাঃ কেরী, ঐ যে বড় হলঘরটা দেখছেন, সেন্ট জন চার্চ তৈরি হওয়ার আগে ওটা প্রেয়ার-হল রূপে ব্যবহৃত হত।
টমাস বলল, ওখানে মেয়েদের পালকি থেকে নামতে বড় অসুবিধা হত। একদিন সেদিন বৃষ্টি হচ্ছিল—গভর্নরের পত্নী এলেন পালকিতে। তিনি নামতে যাবেন, কখন স্কার্ট বেধে গিয়েছে একটা কাঁটায়—সবসুদ্ধ সে এক লজ্জাকর বীভৎস ব্যাপার। সেই দিনই স্থির হল—না, এমন করে চলে না, শহরের যোগ্যতা মাফিক গির্জা গড়তে হবে। উপাসনার শেষেই চাঁদার আবেদন জানানো হল।
কথা বলতে বলতে তিনজন কেল্লার বাইরে এসে পৌঁছল—আর রাস্তাটুকু পার হয়ে ট্যাঙ্ক স্কোয়ারে ঢুকল।
.
১.০৮ ট্যাঙ্ক স্কোয়ার বা লালদিঘি
রামরাম বসু বলল, ডাঃ টমাস, একবার ছেলেবেলায় এখানে কমলালেবু চুরি করতে এসে বারওয়েল সাহেবের চাপরাসীর তাড়া খেয়েছিলাম। ধরা পড়ি আর কি! আমি তো ছুটে পালালাম। কিন্তু পার্বতী ভায়ার দুরবস্থার একশেষ। সে বরাবরই একটু মোটা পালাবার অন্য উপায় না দেখে জলে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে ঐদিকে উঠে পালাল।
কেরী বিস্ময়ের সঙ্গে শুধাল, এখানে কমলালেবু গাছ ছিল নাকি?
ছিল বই কি। সিলেট থেকে কমলালেবুর চারা এনে পুঁতেছিল। আরও কত ফলের ও ফুলের গাছ ছিল।
কেরী শুধায়, তবে এখন এমন লক্ষ্মীছাড়া দশা কেন?
তখন অর্থাৎ কোম্পানির রাজত্বের প্রথম আমলে এই ট্যাঙ্ক স্কোয়ারটাই ছিল সাহেব মেমদের হাওয়া খাওয়ার একমাত্র স্থান-তাই জায়গাটাকে সুন্দর করে সাজিয়েছিল। পলাশীর যুদ্ধের পরে সাহেব-সুবোরা শহরের মধ্যে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে, চাঁদপাল ঘাটের কাছে যেখানে জলা আর জঙ্গল ছিল, সেখানে সুন্দর এপ্ল্যানেড গড়ে তুলেছে। তাই এ জায়গাটার উপর আর তেমন লক্ষ্য নেই।
টমাস বলল—শুধু হাওয়া খাওয়ার একমাত্র জায়গা ছিল না, জল পানেরও একমাত্র পুকুর ছিল।
কিন্তু তা এখনও আছে।
কেরী শুধাল, এই কি পানীয় জল?
পানীয় জল বই কি। সাহেবপাড়ার সমস্ত পানীয় জল এখানে থেকে সরবরাহ হয়।
কেরী বলে—বল কি! ঐ তো দেখছি দুটো কুকুর নেমেছে জলে।
শুধু কুকুর? সুযোগ পেলে লালবাজারের কোচম্যানের দল এখানে ঘোড়া এনে স্নান করিয়ে নেয়। ঐ দেখুন ভিত্তি করে জল নিয়ে যাচ্ছে সাহেববাড়ির জন্যে।
তিনজনে দেখল, পুবদিকের ঘাটে নরনারী স্নান করছে, ভিস্তিওয়ালা ভিস্তি ভরছে। তারা সুরকি-ঢালা পথ ধরে লালদিঘির উত্তরদিক দিয়ে পুবমুখে চলল।
কেরী বলল, শুনেছি এটার নাম লালদিঘি, রেড ট্যাঙ্ক। নামটার অর্থ কি?
টমাস বলল—ঠিক অর্থ কেউ জানে না, নানা লোকের নানা অনুমান। কেউ কেউ বলে, এক সময় পুরনো কেল্লার প্রাচীরের লাল রঙ দিঘির জলে প্রতিফলিত হয় তাই নাম হয়েছিল লালদিঘি।