কেরী বলল, মুন্সী, তুমি কি ভাবছ? বসুজার উত্তর না পেয়ে কেরী বলল, আগামী কালে জগতের শুশ্রূষার স্থান হবে গির্জা।
বসুজা অত্যন্ত বিস্ময় প্রকাশ করে টমাসের উদ্দেশে বলল, ডাঃ টমাস, আজ ডাঃ কেরীর মুখে যে একেবারে ভবিষ্যদ্ভাষণের খই ফুটছে।
টমাস কিছু বুঝল না, তবু এমন কথায় সন্দেহ প্রকাশ অভদ্রতা জ্ঞানে বলল, নিশ্চয়, নিশ্চয়।
এই দেখ না কেন, আর কয়েক গজ উত্তরদিকে এক সময়ে ছিল কোম্পানির আমলের হাসপাতাল–শুশ্রূষার অভাব হচ্ছিল বলেই বোধ করি প্রভুর আদেশে পাশে গড়ে উঠল গির্জা।
টমাস বলে উঠল–চমৎকার।
রাম বসু বলল, কিন্তু চমকারের সবটা এখনও বুঝতে পার নি। প্রভু খ্রীষ্টের চেয়ে খ্রীষ্টানদের দূরদৃষ্টিও কিছু কম নয়। দেখ কেমন ব্যবস্থা কেল্লা, হাসপাতাল আর গোরস্থান কেমন পাশাপাশি তৈরি করেছিল—এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াতে বেশি সময় লাগত না।
কেরী জিজ্ঞাসা করল, কেল্লা তো কাছেই শুনেছি, কিন্তু গোরস্থান?
রাম বসু ও টমাস দুজনে একযোগে বলল—এই জায়গাতেই ছিল খ্রীষ্টানদের প্রাচীনতম গোরস্থান।
বল কি।
টমাস বলল, একটা হিসাবে দেখেছিলাম যে, নৃতন বেরিয়াল গ্রাউণ্ড খোলবার আগে এখানে বারো হাজার লোকের সমাধি দেওয়া হয়েছিল।
এইটুকু জায়গায়? তার মানে, একজনের উপরে আর একজনকে সমাধিস্থ করা হয়েছে?
তা হয়েছে বই কি।
রাম বসু বলল, শেষ বিচারের হুড়োহুড়ি পড়ে যাবে, উপরের জন না উঠলে নীচের জনের ওঠবার উপায় থাকবে না।
ঐ সমাধি-স্তম্ভটা কার?
জব চার্নকের। তাকেই বলা যেতে পারে কোম্পানির কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা।
চল দেখে আসি।
যখন তারা তিনজন সমাধি-স্তম্ভ দেখবার জন্যে অগ্রসর হল, সেই অবসরে মিসেস কেরী এসে উঠে বসল গাড়িতে, অগত্যা পার্বতীকেও উঠে বসতে হল।
কেরী-পত্নী গায়ের শালখানা খুলে পাশে রাখল। এহেন অবস্থায় কি কর্তব্য স্থির করতে না পেরে বেশ শীত অনুভূত হওয়া সত্ত্বেও পার্বতী বলল, আজ বেশ গরম!
কেরী-পত্নী তার সমর্থন বা প্রতিবাদ কিছুই না করে চুপ করে বসে রইল।
ওদিকে জব চার্নকের সমাধির কাছে গিয়ে আনুপূর্বিক ইতিহাস শুনে সধিক্কারে সবিস্ময়ে কেরী শুধাল—তুমি কি বলতে চাও একজন হিদেন রমণীকে নিয়ে কলকাতায় প্রতিষ্ঠাতা বাস করত? খ্রীষ্টান সমাজ স্বীকার করেছিল এ বিবাহ?
ছেলেমেয়ে হল, খ্রীষ্টান সমাজে তাদের বিয়ে হল, জামাই সরকারী বড় কাজ পেল, এক জামাই গড়ে দিল এই স্মৃতিস্তম্ভ। স্বীকার করা আর কাকে বলে?
কি সর্বনাশ! চল, চল।
বহুকাল পূর্বে মৃত জব চার্নকের অখ্রীষ্টানোচিত কাজের প্রতিবাদেই যেন কেরী দ্রুত স্থানত্যাগ করল।
টমাস বলল, কাছেই আরও দুটো দর্শনীয় বস্তু আছে—পুরাতন কেল্লা আর ট্যাঙ্ক স্কোয়ার।
কেরী বলল, তবে এটুকুর জন্যে আর গাড়ি চড়ে কাজ নেই, চল হেঁটেই যাওয়া যাক।
তার পর স্ত্রীর উদ্দেশে বলল, ডরোথি, এস না, নাম, একটু হাঁটা যাক।
পত্নী বিরক্তির চরম সুরে বলল, আমি নামতেও রাজি নই, হাঁটতেও রাজী নই, কিছু দেখতেও রাজী নই।
তখন টমাস কোচম্যানকে বলল, তুমি গাড়ি নিয়ে গিয়ে লালবাজারে রোপওয়াকের কাছে অপেক্ষা কর আমরা এখুনি আসছি।
গাড়ি ডরোথিকে নিয়ে রওনা হল, সঙ্গে রইল পার্বতী ব্রাহ্মণ।
এদিকে কেরী, টমাস ও রাম বসু পদব্রজে পুরাতন কোর দিকে এগিয়ে চলল।
.
১.০৭ ওল্ড ফোর্ট
আস্ত দুটো সাহেব দেখে দারোয়ান সেলাম করে গেট খুলে দিল। না খুললেও ক্ষতি ছিল না, প্রাচীর জায়গায় জায়গায় ভেঙে পড়ে চতুষ্পদ ও দ্বিপদের জন্য স্বাভাবিক দরজা সৃষ্টি করে রেখেছে। তবু যখন কেল্লা, হক পুরাতন আর অব্যবহৃত, একটা গেট আছে। আর গেট যখন আছে, অবশ্যই একজন গেটকীপার বা দারোয়ানও আছে।
ভিতরে প্রবেশ করে কেরী, টমাস ও রাম বসু দেখল জনশূন্য ভগ্নপ্রায় বাড়িগুলো নিরর্থক পড়ে আছে, দরজা-জানলার অধিকাংশই ভাঙা।
রাম বসু ও টমাস আগেও দু একবার এর ভিতরে ঢুকেছে। এবার কেরীকে দেখাবার জন্যেই প্রবেশ, নইলে তাদের কোন আগ্রহ ছিল না।
স্বদেশে থাকতেই ‘ব্ল্যাক হোল ট্রাজেডি’ বা ‘অন্ধকূপ হত্যা’র সংবাদ কেরীর কানে পৌঁছেছিল, তাই সে ঘরটা দেখবার আগ্রহ প্রকাশ করল।
রাম বসু বলল, সেদিকে যাওয়া যাক।
কেরী বলল, ততক্ষণ পুরনো কেল্লার ইতিহাস বল, সব কথাই তোমার জানা থাকবার কথা, মিঃ মুন্সী!
মুন্সী অর্থাৎ রাম বসু বলল, তা আপনি নেহাৎ মিথ্যা বলেন নি। কলকাতা শহরেই আমার বাস, এখানেই আমার জন্ম, আর জন্মসালটাও নাকি ১৭৫৭, যে বছর পলাশীর যুদ্ধে কোম্পানির ফৌজ নবাবকে হারিয়ে দেয়।
তাহলে তুমি নিশ্চয় লর্ড ক্লাইভকে দেখেছ?
লর্ড ক্লাইভ, ওয়ারেন হেস্টিংস, সার ফিলিপ ফ্রান্সিসকাকে দেখি নি! একদিন সকালবেলায় এদিকে এসেছিলাম চীনাবাজারে। দেখলাম একজন সাহেব ঘোড়ায় চড়ে চলেছেন, সঙ্গে কয়েকজন ফৌজী ঘোড়সওয়ার। জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম—জঙ্গী লাট ক্লাইভ। সত্য কথা বলতে কি, দেখে বীরপুরুষ বলে মনে হল না। আরও শুনলাম, গোবিন্দপুরে যে নতুন কেল্লা তৈরী হচ্ছে তাই দেখতে চলেছেন।
টমাস বলল, আরে বীরপুরুষ কি অষ্টপ্রহরই বীরপুরুষ! তা নয়। তারা যুদ্ধক্ষেত্রে বীর, অন্য ক্ষেত্রে আমাদের মতই মানুষ।
আর ওয়ারেন হেস্টিংসকে দেখেছিলাম, ওল্ড পোস্ট অফিস স্ট্রীটের মোড়ের বাড়িটায়, এখন যার পাশে মিসেস ফে নামে এক ইংরেজ রমণী কাপড়ের দোকান খুলেছে। হঠাৎ তাকে দেখে কোন ইংরেজ কেরানী বলে মনে করেছিলাম। পরিচয় জেনে পালিয়ে বাঁচি।