মিসেস কেরী শুধায়—প্রকাণ্ড পাখী! ঈগল নাকি?
না, ওগুলোকে বলে হাড়গিলে, Bone-swallower!
কোথায় থাকে?
রামরাম বসু বলল, মাঠের মাঝে যেসব বড় বড় জলা আছে সেখানে ওদের বাস।
এত বড় বাড়িটা খালি পড়ে আছে কেন?–সেই বাড়িটা দেখিয়ে শুধায় কেরী।
ডাঃ কেরী, এত বড় বাড়িতে থাকবে কে? বিশেষ ভিতরটা ভেঙেচুরে গিয়েছে!
নিশ্চয় খুব শৌখিন লোক থাকত?
তোমার অনুমান মিথ্যা নয়, এক সময়ে ওয়ারেন হেস্টিংস বাস করত এখানে। এই যে সামনেই পাশাপাশি গভর্নরের কুঠি আর কাউন্সিল হাউস।
এমন কিছু বড় ব্যাপার নয়।
সেটাই তো এখানকার ইংরেজ সমাজের অভিযোগ। তারা বলে, এর চেয়ে বড় বাড়ি অনেক সওদাগরের আছে।
টমাস বলে চলে-মিসেস কেরী, ঐ যে দূরে চাঁদপাল ঘাট, আর ঐ গঙ্গা–হিন্দুদের কাছে সবচেয়ে পবিত্র নদী।
মিসেস কেরী অস্পষ্টভাবে কি বলল বোঝা গেল না; ভালই হল, কারণ খুব সম্ভব সে-কথা উপস্থিত দুইজন হিন্দুর রুচিকর বোধ হত না।
টমাস বলছে—এবারে আমরা কাউন্সিল হাউস স্ট্রীট ধরে উত্তরমুখে ঘুরেছি—আর চলেছি কলকাতার সবচেয়ে পুরনো, ঐতিহাসিক ঘটনাপূর্ণ অংশে। ডাঃ কেরী, এখানকার প্রত্যেক ইষ্টকখও বিচিত্র ইতিহাসের দ্বারা চিহ্নিত। ঐ যে সুপ্রীম কোর্ট, নেটিভরা বলে কি বলে মুন্সীজি?
বড় আদালত।
ঠিক ঠিক। বরা আদালত, অনুবৃত্তি করে টমাস।
ডাঃ কেরী, মিসেস কেরী, এবারে আমাদের নামতে হবে, সুমুখেই সেন্ট জনস চার্চ, কলকাতার সবচেয়ে বড় গির্জা, এই সেদিনমাত্র তৈরি হয়েছে। ঐ যে গায়ে তারিখটা
স্পষ্ট পড়া যাচ্ছে—‘১৭৮৭ অ্যানো ডমিনি’।
১.০৬-১০ পাথুরে গির্জা
১.০৬ পাথুরে গির্জা
গির্জাটি মাত্র বছর কয়েক আগে তৈরি হয়েছে, এখনও সব ঝকঝক তকতক করছে, চারদিক ঘিরে ফুলের বাগান।
কেরী ও টমাস গিয়ে গির্জের কাছে নতজানু হয়ে বসল আর প্রার্থনা শুরু করল, পাশে দাঁড়িয়ে রইল রামরাম বসু। মিসেস কেরীর সঙ্গে চলছিল পার্বতী ব্রাহ্মণ। মিসেস কেরী সমস্ত ব্যাপারটার উপরে বীতশ্রদ্ধ হয়ে গিয়েছিল, মুখে চোখে তার ফুটে উঠেছে বিরক্তি। বিনা ভাষায় কিভাবে কেরী-পত্নীর মনোভাব সমর্থন করা যায় তারই চেষ্টা করছিল পার্বতী। কেরী-পত্নী থামে তো পার্বতী থামে, কেরী-পত্নী চলে তো পার্বতী চলে; কেরী পত্নী বিরক্তিসূচক ‘ইস’ বললে পার্বতী অনুরূপ ‘ইস’ বলে, কেরী-পত্নী আকাশের দিকে তাকালে পার্বতীও একবার আকাশের দিকে তাকায়।
ওদিকে ইতিমধ্যে কেরী ও টমাস উঠে দাঁড়িয়েছে। এতক্ষণে তাদের খেয়াল হয়েছে যে দ্বিতীয় গাড়ি এসে পৌঁছয় নি। কেরী শুধাল—ওরা গেল কোথায়?
রাম বসু বললে, যাদের বয়স কুড়ির কোঠায়, গির্জা আর গোরস্থান দেখার আগ্রহ তাদের হবার কথা নয়।
কথাটা টমাসের বড় লাগসই লাগল, সে বলল, মুন্সী, তোমার কথা খুব সত্যি। কুড়ির কোঠায় আমি তো আধখানা শয়তান ছিলাম।
রাম বসু মনে মনে বলল, এখন পুরো শয়তান হয়েছ, জুয়োর আচ্ছা তোমার গিঞ্জে, মদের বোতলে তোমার জর্ডানের দীক্ষাবারি। দাঁড়াও না, একদিন টুশকির বাড়ি নিয়ে যাই, তখন পরীক্ষা হবে তোমার খ্রীষ্ট-ভক্তির।
কেরী গির্জার চুড়ার দিকে তাকিয়ে রাম বসুকে বলল, মিঃ মুন্সী, অদূর ভবিষ্যতে পৃথিবীর সব জাতের আশ্রয় হবে প্রভু খ্রীষ্টের এই গির্জা, সব ধর্মের লোক এসে এখানে হাত মেলাবে।
রাম বসু বলল, ডাঃ কেরী, আপনার কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্য, কিন্তু তার জন্যে ভবিষ্যতের আশায় বসে থাকতে হবে না।
রাম বসুর কথায় কেরীর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, ব্যস্তভাবে শুধাল, কি রকম?
তবে এ গির্জা তৈরির ইতিহাস শুনুন, বুঝতে পারবেন কত জাত আর কত ধর্মের সমবায়ে এ গির্জা গঠিত।
এই বলে রাম বসু সেন্ট জন গির্জা তৈরির ইতিহাস বলতে শুরু করল
একজন হিন্দু রাজার দত্তা জমিতে এর ভিত্তিপত্তন, আর গির্জার পাথর আনা হয়েছে রাজমহল বলে একটা জায়গার নবাবী প্রাসাদ ভেঙে। সেই সুবাদে দেশীয় লোকেরা এটাকে বলে ‘পাথুরে গির্জা’। কাজেই দেখতে পাচ্ছেন যে, হিন্দু-মুসলমান ও খ্রীষ্টানের মিলন ইতিমধ্যেই ঘটেছে গির্জা গঠনে!
এখন, কেরী ও টমাস ধর্মবাতিকগ্রস্ত না হয়ে সাধারণ মানুষ হলে রাম বসুর কথা কি ভাবে গ্রহণ করতে হবে বুঝতে পারত, কিন্তু ওরা পারে না, ওরা ভাবে রাম বসু মস্ত একটা ভাবের কথা বলেছে, মুন্সীর প্রতি তাদের ভক্তি বাড়ে। ভক্তি জিনিসটারই ঐ প্রকৃতি প্রেম যদি অন্ধ হয়, ভক্তি অবুঝ।
কেরী বলল, শুধু তাই নয়, এমন সময় একদিন আসবে, যখন জগতে যুদ্ধবিগ্রহ থাকবে না, অস্ত্রাগারের উপর গড়ে উঠবে গির্জা।
রাম বসু বলল, পাদ্রী সাহেব, আপনার দিব্যদৃষ্টি না থেকে যায় না। অস্ত্রাগারের উপরেই গড়ে উঠেছে গির্জাটি, তবে ঠিক অস্ত্রাগার নয়, বারুদখানা। এই জায়গায় এক সময়ে কোম্পানির বারুদখানা ছিল।
কেরী সোৎসাহে বলল, মুন্সী, অদ্ভুত তোমার ব্যাখ্যা করবার শক্তি। তোমার মত ব্যাখ্যাতা পেলে এদেশে প্রভুর করুণা বিতরণ করতে বেশি সময় লাগবে না।
বসুজা মনে মনে বললে, প্রভুর করুণার জন্যে আমার বা আমার দেশের লোকের মাথাব্যথা নেই। আগে প্রভুর চেলাদের করুণার বহর বুঝি। কিন্তু ব্যাপার দেখে মনে হচ্ছে মুঠো খুব শক্ত, মাসিক কুড়ি টাকার বেশি করুণা আদায় করতে পারলাম না।