এদিকে পুব আকাশের খাড়া পাড় বেয়ে সূর্যটা অনেকখানি ওপরে উঠে এসেছে। আশ্বিনের রোদ এখন বেশ ধারাল। আকাশের নীল এত ঝমঝকে যে সেদিকে চোখ পেতে রাখা যায় না। স্টিমারে থাকতে যে পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘগুলোকে এদিকে ওদিকে জমে থাকতে দেখা গিয়েছিল, শরতের এলোমেলো বাতাস পেঁজা তুলোর মতো তাদের দিগ্বিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিচ্ছে। নিচে নদীটা সারা গায়ে সোনালি রোদের আদর মেখে টলমল করে চলেছে।
মুগ্ধ চোখে বিনু দেখছিল। জীবনে যত দৃশ্য সে দেখেছে, মনে মনে সেগুলোর সঙ্গে এই আকাশ আর দূরের ভারহীন মেঘদলের তুলনা করে নিচ্ছিল, কোনটা বেশি সুন্দর?
এক জায়গায় এসে দেখা গেল, সিধে চলতে চলতে রাস্তা হঠাৎ বাঁ দিকে ঘুরেছে। বাঁক ঘুরে ফিটনও সেদিকে চলতে লাগল। খানিক যাবার পর সঙ্গের সেই নদীটা আর নেই, গাছগাছালির
ওধারে কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে।
বাঁকের মুখ পর্যন্ত রাস্তাটা ছিল খোয়ায় ঢাকা। এখন খোয়া টোয়া নেই। কৌলীন্য হারিয়ে সোজা মাটিতে নেমে গেছে।
ঘোড়ার গলায় বোধ হয় ঘুন্টি বাঁধা আছে। চলার তালে তালে ঠুনঠুন শব্দ হচ্ছে।
নদী নেই। মাটির রাস্তায় খানিক যাবার পর দু’ধারে খাল পড়ল। বিনুদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সে দুটো যেন ছুটছে। মধ্যঋতু এই শরতে খালগুলো কানায় কানায় ভরা। তবে তাতে স্রোত নেই। নিস্তরঙ্গ স্থির জলে কোথাও কচুরিপানা, কোথাও নলখাগড়ার বন মাথা তুলে আছে। আর আছে ছোট ছোট নৌকো। মাঝে মাঝে এক-আধটা বাঁশের সাঁকো, মাছরাঙা আর বক চোখে পড়ছে। ফুলভর্তি হিজল গাছে শালিক বসে আছে অনেক।
খালের ওপাড়ে দূরে দূরে কিছু কিছু বাড়িঘর দেখা যায়। বেশির ভাগই টিনের চালের। কদাচিৎ দু’চারখানা পাকা বাড়ি। এই রাজদিয়াতে লোকালয়ের রূপ ঘনবদ্ধ নয়, দ্বীপের মতো ছড়ানো।
চারদিকে এত জল দেখতে দেখতে অনেক দিন আগে পড়া একটা শহরের কথা মনে পড়ে গেল বিনুর। সেখানে রাস্তার বদলে শুধু খাল। গাড়িঘোড়া নেই সেই মজার শহরটায়। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে হলে নৌকোই ভরসা। এই মুহূর্তে স্মৃতি তোলপাড় করেও শহরটার নাম কিছুতেই মনে করতে পারল না বিনু।
কখন যে ফিটন দুটো একটা বড় কাঠের পুলের ওপর এসে উঠেছে, খেয়াল নেই। হঠাৎ কে যেন জোরে চেঁচিয়ে উঠল, গাড়ি থামা রসুল, গাড়ি থামা–
গতি কমতে কমতে গাড়িটা পুলের মাঝামাঝি চলে এল।
এদিকে বিনু চমকে উঠেছিল। তাড়াতাড়ি জানালা দিয়ে মুখ বাড়াতেই দেখতে পেল, কে একজন বড় বড় পা ফেলে তাদের ফিটনটার দিকে এগিয়ে আসছে। খুব সম্ভব সে-ই গাড়ি থামাতে বলেছে।
একটু পরেই ফিটনের জানালায় একটি মুখ দেখা গেল।
পাকা ভুরু কুঁচকে হেমনাথ বললেন, হিরণবাবু মনে হচ্ছে—
বিনুর মনে পড়ল, কিছুক্ষণ আগে জেটিঘাটে দাদুর মুখে ‘হিরণ’ নামটা শুনেছে। এই তবে হিরণ। কাছাকাছি আসতে তাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বয়স তেইশ চব্বিশের মধ্যেই। এক কথায় পরিপূর্ণ যুবক। সিঁথি নেই। মাথার চুল এলোমেলোভাবে পেছনে উলটে দেওয়া। গায়ের রং কালোর দিকে, এটা খুঁত নয়। বরং কালো রঙে হিরণের ব্যক্তিত্ব আরো বেশি করে ফুটেছে। চোখদুটি ভাষাময়, উজ্জ্বল। পাতলা ঠোঁটের ওপর সূক্ষ্ম গোঁফের রেখা। পায়ে নকশা করা স্যাণ্ডেল। পরনে পাটভাঙা ধবধবে পাজামা, আর দোমড়ানো মোড়ানো হাফ শার্ট। পোশাকের ব্যাপারে তো বটেই, নিজের সম্বন্ধেই হয়তো সে উদাসীন। তবু সব মিলিয়ে হিরণ বেশ সুপুরুষ। তার মধ্যে কোথায় যেন একটা আকর্ষণ আছে। প্রথম দেখায় অবশ্য স্পষ্ট করে সেটা বোঝা যায় না, তবে হালকাভাবে অনুভব করা যায়।
হেমনাথ এবার বললেন, এতক্ষণে আসার সময় হল?
চোখ নামিয়ে, ঘাড় চুলকোতে চুলকোতে হিরণ বলল, একটু দেরি হয়ে গেল।
কোন দিন ঠিক সময়ে ঠিক জায়গাটিতে হাজিরা দাও শুনি? চিরকালের তুমি লেট লতিফ।
না, মানে—
মানেটা আবার কী হে–
কাল সন্ধেবেলা জারি গান শুনতে গিয়েছিলাম। মাঝরাত্তিরে ফিরে এসে এমন ঘুমিয়েছি যে ভোরবেলায় উঠতে পারি নি।
হেমনাথ বললেন, কাল না হয় মাঝরাত্তিরে শুয়েছ। যেদিন সন্ধে রাত্তিরে শোও সেদিনও কি ভোরবেলা ওঠ? তেইশ চব্বিশ বছর তো বয়েস হল। সূর্যোদয়ের আগে ক’দিন উঠেছ বল তো?
সমানে ঘাড় চুলকেই যাচ্ছিল হিরণ। ভয়ে ভয়ে একবার চোখ তুলে ফিসফিসিয়ে বলল, একদিনও না। সূর্যোদয়ের আগে ঘুম থেকে ওঠা আমার কোষ্ঠীতে নেই।
হেমনাথ উচ্ছ্বসিত গলায় বলে উঠলেন, এই–এতদিনে একটা সত্যি কথা বলেছিস হিরণ।
অবনীমোহন বিনু সুরমা, সবাই সকৌতুকে তাকিয়ে ছিলেন। হিরণ আর হেমনাথের ভেতর যে মজার ব্যাপারটা চলছে, বেশ উপভোগই করছিলেন বলা যায়। এবার তারা হেসে উঠলেন।
হাসি থামতে অবনীমোহনদের দেখিয়ে হিরণ বলল, ওঁদেরই তো আসবার কথা ছিল?
হেমনাথ মাথা নাড়লেন, হ্যাঁ। আয়, তোদের আলাপ-টালাপ করিয়ে দিই।
সুরমা বিনু আর অবনীমোহনের পরিচয় দিলেন হেমনাথ। হিরণ শুধলো, আপনাদের কী বলে ডাকব?
সস্নেহে সুরমা বললেন, তোমার যা ইচ্ছে।
আমার ইচ্ছে মাসিমা আর মেলোমশাই বলি।
বেশ তো।
হিরণ বলল, ফিটনে যা মালপত্র, ওঠাই মুশকিল। বাড়ি গিয়ে আপনাদের প্রণাম করব।
হাসিমুখে সুরমা বললেন, তাই করো, প্রণামটা পাওনা রইল।
হেমনাথ এবার সুরমার চোখে চোখ রেখে বললেন, এবার শ্রীমানের পরিচয় দিই।