সুরমা বললেন, আমার কথা কি লালমোহন মামার মনে আছে?
খুব আছে। হেমনাথ বলতে লাগলেন, তোর কথা কত বলে। আসবি শুনে তো নেচে উঠেছিল।
স্টিমারঘাটে উনি এলেন না তো?
সুজনগঞ্জে আজ হাট আছে। ভোরবেলা উঠে সেখানে চলে গেছে। দেখিস, রাত্তিরে ফিরেই ছুটে আসবে।
সুরমা কী বলতে যাচ্ছিলেন, ফিটনটা হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। ওপর থেকে রসুল বলল, বাজার আইস্যা গ্যাছে বড় কত্তা।
হেমনাথ বললেন, তোরা একটু বস, এক্ষুনি আসছি। গাড়ির দরজা খুলে তিনি নেমে গেলেন। ঝিনুক সঙ্গ ছাড়ে নি। কোলে ঝুলতে ঝুলতে সেও গেল। জানালা দিয়ে বিনু দেখতে পেল, চেরা বাঁশ আর হোগলায় ছাওয়া সেই দোকানগুলো সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে। স্টিমার থেকে বোঝা যায় নি, কাছে আসতে টের পাওয়া গেল, ওগুলো মিষ্টির দোকান। কাঁচের আলমারির ভেতর বড় বড় গামলাভর্তি রসগোল্লা আর প্রকান্ড পেতলের থালায় মাখা সন্দেশ স্থূপাকার হয়ে আছে। কয়েকটা দোকানে হলুদ রঙের অসংখ্য কলার ছড়া ঝুলছে।
একটু পর মস্ত মাটির হাঁড়ি আর কলার ছড়া হাতে ঝুলিয়ে হেমনাথ ফিরে এলেন। হাঁড়িটার মুখ কলাপাতা দিয়ে বাঁধা। নিজের জায়গায় বসতে বসতে বললেন, আমাদের রাজদিয়া রসগোল্লার জন্যে ফেমাস। দাদাভাই আর দিদিভাইদের জন্যে নিয়ে এলাম।
অবনীমোহন হঠাৎ বললেন, কিরকম দর?
ছ’আনা সের।
মোটে!
বছরখানেক আগেও তিন আনা, চোদ্দ পয়সা ছিল। এখন তো দাম বেড়ে গেছে।
ছ’আনা রসগোল্লার সের! এখানে না এলে এত শস্তা কল্পনাও করতে পারতাম না।
হেমনাথ হাসলেন, একেই শস্তা বলছ! ফাস্ট গ্রেট ওয়ারের আগে এই রাজদিয়ার বাজারে তিন পয়সা সের রসগোল্লা কিনেছি। দেখতে দেখতে ক’বছরে তার দাম ছ’আনায় উঠেছে। আরেকটা লড়াই ভাল করে বাধলে দাম যে কোথায় চড়বে, কে জানে। বলতে বলতে হঠাৎ কী মনে পড়ে গেল, হ্যাঁ, ভাল কথা–
অবনীমোহন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন।
হেমনাথ বললেন, ইউরোপে যুদ্ধ বেধেছে। খবরের কাগজে তার খবর পড়ছি। এদেশেও নাকি ছড়িয়ে পড়তে পারে।
অবনীমোহন কিছু বললেন না। একটুক্ষণ চুপ করে থেকে উৎসুক সুরে হেমনাথ ডাকলেন, আচ্ছা অবনী—
আজ্ঞে– অবনীমোহন উন্মুখ হলেন।
আমরা তো পৃথিবীর শেষ মাথায় পড়ে আছি। বাইরের কোনও খবর এখানে এসে পৌঁছতে যুগ কেটে যায়। তোমরা খাস কলকাতায় থাকো। ওখানে যুদ্ধের হাওয়া টাওয়া কিরকম দেখে এলে?
এখনও তেমন কিছু না।
তবু?
হিটলার ওয়ার ডিক্লেয়ার করেছে। গোলমাল চলছে। সে সব ইউরোপে। আমার মনে হয়, এটা সময়িক। টেনশন খুব একটা দীর্ঘস্থায়ী হবে না।
এটা উনিশ শ’ চল্লিশের অক্টোবর। এক বছর আগেই যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ইউরোপের বাতাসে এখন বারুদের গন্ধ। ট্যাঙ্ক আর অ্যান্টি-এয়ারক্র্যাফটের শব্দে আকাশ চৌচির হয়ে যাচ্ছে। সংশয়ে-উত্তেজনায়-মত্ততায় সুদূর সেই মহাদেশ ঢেউয়ের দোলায় দুলছে।
আর উনিশ শ’ চল্লিশের বাংলাদেশ এত স্নিগ্ধ, এত নিরুদ্বেগ যে মনেই হয় না, ইউরোপ মাত্র কয়েক হাজার মাইল দূরে আর সেটিকে ঘিরে একখানা আগুনের চাকা ঘুরে চলেছে। ইউরোপ বুঝি এই গ্রহের অংশ নয়। সৌরলোকের বাইরে কোনও অজানা, অনাবিষ্কৃত দেশ। বাংলাদেশের অগাধ শান্তি আর নিশ্চিন্ত জীবন যুদ্ধের আঁচে ঝলসে যাবে, এমন সম্ভাবনা এখনও দেখা যাচ্ছে না।
অন্যমনস্কের মতো হেমনাথ বললেন, আমার কিন্তু তা মনে হয় না অবনী–
কী মনে হয়? অবনীমোহন শুধোলেন।
এ লড়াই বহুদিন চলবে, অনেক লোক মরবে, নানা দেশ তছনছ হয়ে যাবে।
অবনীমোহন কিছু বললেন না, তাকিয়ে রইলেন।
হেমনাথ বললেন, তুমি হয়তো ভাবতে পার, আমার এরকম ধারণা কেন হল?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
কেন জানো? ওই জার্মান জাতটার জন্যে। এমন আত্মাভিমানী জাত দুনিয়ায় আর আছে কিনা সন্দেহ। মর্যাদাবোধ তার অত্যন্ত প্রখর। ফার্স্ট গ্রেট ওয়ারের গ্লানি সে ভোলে নি। প্রতিহিংসা না মেটা পর্যন্ত জার্মানরা থামবে বলে মনে হয় না।
অবনীমোহন চুপ করে রইলেন। মুখ দেখে মনে হল, হেমনাথের ব্যাখ্যা তার খুব মনপূত হয় নি।
এই সময় কলার ছড়াটার দিকে আঙুল বাড়িয়ে সুরমা হঠাৎ উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন, ভারি চমৎকার তো। সেবার যখন তোমার কাছে এসেছিলাম, রোজ এই কলা কিনে আনতে না মামা?
তোর মনে আছে? হেমনাথ হাসলেন, আমি কিন্তু ভুলে গেছি রে—
বা রে, মনে থাকবে না! আমার স্মৃতিশক্তি খুব খারাপ নাকি? সুরমাও হাসলেন, এই কলাগুলোর কী যেন নাম?
অমৃতসাগর।
হ্যাঁ হ্যাঁ, অমৃতসাগর।
অবনীমোহন মুগ্ধ স্বরে বললেন, সুন্দর নাম তো।
হেমনাথ বললেন, নামেই শুধু নয়, গুণেও সুন্দর। যেমন মিষ্টি তেমনি স্বাদ। আর দামও বাড়ে নি। দশ বিশ বছর ধরে তিন পয়সা হালি।
বিনু জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিল। গাড়িতে উঠবার পর থেকে দাদু-মা-বাবা অনবরত কথা বলছেন। হিটলার-জার্মানি-লারমোর-ইউরোপ-অমৃতসাগর, টুকরো টুকরো অনেক শব্দ অসংলগ্ন ভাবে কানে আসছিল। হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে সে বলল, দাদু, হালি’ কাকে বলে? কথাটা তার কাছে অদ্ভুত লেগেছে।
এক গন্ডা জিনিসকে আমরা এখানে হালি বলি।
ও। বিনু আবার জানালার বাইরে তাকাল।
ফিটন চলেছে তো চলেছেই। দেখতে দেখতে হোগলা-ছাওয়া সেই দোকান ঘরগুলো চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল।
রাস্তার একধারে ছিল সারি সারি দোকান, আরেক ধারে নদী। নদীটা এখনও সঙ্গে সঙ্গে চলেছে। বিনু দেখতে পেল, দূরে জেটিঘাটে বিশাল রাজহাঁসের মতো তাদের সেই স্টিমারটা নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে। উঁচু মাস্তুলটার মাথায় একটা শঙ্খচিল, চুপচাপ বসে। তাকে ঘিরে ছাইরঙের অচেনা কটা পাখি চক্কর দিচ্ছে। বিনুরা যত এগুচ্ছে, স্টিমারটা ততই পেছন দিকে সরে সরে যাচ্ছে।