এই ঝিনুকটা, বুঝলি– গাঢ়, বিষাদময় স্বরে হেমনাথ বললেন, বড় দুঃখী রে, বড় দুঃখী–
সুরমার চোখেমুখে উৎকণ্ঠা ফুটল। বললেন, দুঃখী! কেন?
খুব আস্তে আস্তে হেমনাথ বললেন, পরে বলব। এসেছিস যখন সব জানতে পারবি।
সুরমা আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না।
বার বছরের বিনু দুঃখী শব্দটা জানে। চকিতে সে একবার ঝিনুককে দেখে নিল।
১.০২ স্টিমারঘাটের বাইরে
স্টিমারঘাটের বাইরে আসতেই বিনুরা দেখতে পেল, উঁচু রাস্তার ওপর পর পর দু’খানা ফিটন দাঁড়িয়ে। একটা গাড়ি বেশ নতুন, ঝকঝকে। যে ঘোড়াটা তাকে টানে সেটা চমৎকার। স্বাস্থ্যে আর লাবণ্যে ঝলমল করছে। ঘাড়ের কাছে কেশরগুলো সগর্বে ফুলে আছে। সারা গা বাদামি রঙের চকচকে চিকন লোমে ঢাকা, দেহ মসৃণ। মনে হয়, তেল গড়িয়ে পড়বে। ঘোড়াটা এত চঞ্চল আর সজীব যে এক মুহূর্ত স্থির হয়ে নেই। সমানে পা ঠুকে যাচ্ছে।
অন্য গাড়িটা অনেকদিনের পুরনো। ছাদ, কোচোয়ানের বসবার জায়গা, রেকাব প্রায় সবই ভেঙেচুরে গেছে। গাড়ির মতো তার বাহনটিরও দশা খুবই করুণ। কোমর নেই বললেই হয়। লোম। উঠে উঠে কত জায়গায় যে চামড়া বেরিয়ে পড়েছে! পাঁজরার হাড় একটা একটা করে গুনে নেওয়া। যায়। ঘোড়াটা এত বয়স্ক, নির্জীব আর অবসন্ন যে দাঁড়িয়ে থাকতেও তার বড়ই কষ্ট।
দুখানা গাড়িরই চালকের সিটে লোক বসে আছে। নতুন গাড়ির কোচোয়ানটি যুবক। ছিমছাম চেহারা, চুলের ছাঁট এবং লুঙ্গির নকশা বেশ বাহারি। দ্বিতীয় গাড়িটার জীর্ণতার সঙ্গে মিলিয়ে তার কোচোয়ান বেশ বুড়ো, রুগ্ণ। পরনে নোংরা লুঙ্গি, চিটচিটে গেঞ্জি, কাঁধে ময়লা গামছা।
হেমনাথ বললেন, মালপত্তর সব গাড়িতে তুলে দে।
কুলিরা সিটের ওপরেই দুমদাম বাক্স-প্যাঁটরা ফেলে ভাড়া মিটিয়ে নিয়ে জেটিঘাটের দিকে ছুটল।
হেমনাথ বললেন, ব্যাটারা কেমন ছড়িয়ে রেখে গেল দেখ। লোকে বসে কোথায়? বলে কোল থেকে ঝিনুককে নামিয়ে টানাটানি করে মালপত্র গোছগাছ করতে লাগলেন। অবনীমোহনও তার সঙ্গে হাত লাগালেন।
বাক্স টাক্স সাজিয়ে রাখতে রাখতে হেমনাথ বললেন, হিরণটাকে স্টিমারঘাটে আসতে বলেছিলাম। সে এলে এসব তার ঘাড়েই চাপানো যেত। বাবু বোধহয় আসার কথা ভুলেই গেছে।
সুরমা বললেন, হিরণ কে গো মামা?
দত্তবাড়ির দ্বারিক দত্তর নাতি।
সুরমা আর কিছু জিজেস করলেন না। দ্বারিক দত্তর নাতিকে চিনতে পারেলেন কিনা বোঝা গেল না।
লটবহর সাজানো হলে হেমনাথ বললেন, উঠে পড় সব, উঠে পড়—
নতুন গাড়িটা বেশ বড়সড়। ভেতরে অনেক জায়গা। সুরমা বিনু অবনীমোহন ঝিনুক আর হেমনাথ সেটায় উঠলেন। সুধা সুনীতি অন্যটায়।
গাড়িতে উঠবার পর ঝিনুক হেমনাথের কোলে বসল। তাকে নামাতে চেষ্টা করেও পারলেন না হেমনাথ। তাঁর ভাগ খুব সহজে, বিনা যুদ্ধে আর কাউকে ঝিনুক দেবে, এমন মনে হয় না। ফিটন চলতে শুরু করেছিল। জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে হেমনাথ চেঁচিয়ে বললেন, বাজারের কাছে গাড়িটা একটু থামাস রসুল–
ওপর থেকে পূর্ববঙ্গীয় টানে কোচোয়ানের গলা ভেসে এল, আইচ্ছা বড়কত্তা–
স্টিমার থেকে বিনুর চোখে পড়েছিল, নদীর ধারটা বাঁধের মতো উঁচু। তার ওপর দিয়ে খোয়া-বিছানো রাস্তা সোজা উত্তরে চলে গেছে। ফিটন দুটো সেই রাস্তা ধরে এখন ছুটছে।
খানিক যাবার পর সুরমার গলা শোনা গেল। আস্তে করে তিনি ডাকলেন, মামা—
হেমনাথ তক্ষুনি সাড়া দিলেন, কী বলছিস রমু?
বিয়ের আগে আমি যখন রাজদিয়া এসেছিলাম তখন তো তোমার ফিটন ছিল না।
না।
কবে কিনেছ?
পা দুটো থাকতে ফিটন কিনতে যাব কোন দুঃখে? হেমনাথ বলতে লাগলেন, তোর নিশ্চয়ই মনে আছে, আমি চিরকালের পদাতিক। এখনও দিনে পাঁচ সাত মাইল না হাঁটলে পেটের ভাত হজম হয় না।
সুরমা বললেন, মনে থাকবে না? খুব আছে। গাড়িঘোড়া চড়া তোমার ধাতেই নেই। যদুর জানি, রাজদিয়াতে ভাড়ার গাড়ি পাওয়া যায় না। এই ফিটন দু’টো তবে
সুরমার কথার মধ্যে অনুচ্চারিত একটা প্রশ্ন ছিল। হেমনাথ বুঝলেন। বললেন, এ দুটো আমার। একটা ঝিনুকদের, আরেকটা লালমোহনের। তোরা আসবি বলে ওদের কাছ থেকে চেয়ে এনেছি।
লালমোহন!
হ্যাঁ রে–
কোন লালমোহন বল তো? হেমনাথের দিকে অনেকখানি ঝুঁকলেন সুরমা। তার চোখেমুখে, কণ্ঠস্বরে কৌতূহল।
তুই কি চিনবি? ওর আসল নাম তো লালমোহন না-ডেভিড লারমোর। এ দেশের লোক লারমোর উচ্চারণ করতে পারে না, বলে লালমোহন। ও আমার অনেক কালের বন্ধু।
চিনব না, বল কী! কী চমৎকার মানুষ লালমোহন মামা! বিয়ের আগে তোমার কাছে এসে কিছুদিন থেকে গেছি, তখন আলাপ হয়েছিল। একবার আলাপ হলে ওঁকে কি কেউ ভুলতে পারে।
সব সময় হাসিমুখ। কথা থেকে চাউনি থেকে, স্নেহ যেন ঝরে পড়ছে। সুরমা বললেন, উনি। রাজদিয়াতে আছেন?
হেমনাথ বললেন, আছে বৈকি। পঁচিশ বছর বয়েসে আয়াল্যান্ড থেকে এসেছিল, এখন ওর বয়েস পঁয়ষট্টি। চল্লিশ বছর ও ইস্টবেঙ্গলে কাটিয়ে দিল। এর ভেতর একবারও দেশে যায় নি।
অবনীমোহন এতক্ষণ চুপ করে ছিলেন। হঠাৎ বললেন, এ দেশকেই বোধ হয় নিজের দেশ করে নিয়েছেন।
হেমনাথ বললেন, ঠিক বলেছ। জন্মভূমির কথা ও একরকম ভুলেই গেছে। সেখানে আত্মীয়স্বজন কেউ আছে কিনা, লারমোর বলতে পারবে না। যৌবনে ক্রিশ্চানিটি প্ৰিচ করতে বাংলাদেশের এই প্রান্তে এসেছিল। কর্মভূমিই এখন ওর স্বদেশ। আয়ার্ল্যান্ডের চাইতেও ইস্টবেঙ্গল ওর কাছে অনেক বেশি আপন।