সুনীতি কিছু বলল না। মুখ টিপে হাসতে লাগল।
সুধা কিন্তু ঝঙ্কার দিয়ে উঠল, বুড়ো থখুড়ে। আবদার কত! আপনার পাটরানী হতে আমার বয়েই গেছে।
আমুদে গলায় হেমনাথ বললেন, বুড়ো বলে দাগা দিলে ভাই।
কলকল করে সুধা কী বলতে যাচ্ছিল, সেই সময় ভিড় ঠেলে বিনু হেমনাথের পা ছুঁল। চকিত হেমনাথ বললেন, কে রে? কে রে? পরক্ষণেই চওড়া বিশাল একখানা বুকের ভেতর ধরা পড়ে গেল বিনু।
সুরমা বললেন, ও তোমার দাদাভাই মামা। সবার সঙ্গে কথা বলছ, গল্প করছ, ওর দিকে একবারও তাকাচ্ছ না। এ কি সহ্য হয়? তাই নিজেই আলাপ টালাপ করে নিতে এগিয়ে এসেছে। হিংসের একখানা পুঁটুলি।
ভারি অন্যায় হয়ে গেছে। সবার আগে দাদাভাইয়ের সঙ্গে আলাপ করা উচিত ছিল। বুকের ভেতর থেকে বার করে এনে বিনুকে দুহাতে ওপরে তুলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগলেন হেমনাথ।
যেভাবে হেমনাথ ঘোরাচ্ছেন ফেরাচ্ছেন তাতে বিনুর মনে হল, এই বয়সেও মানুষটি যুবকের মতো শক্তিমান।
হেমনাথ বললেন, দাদাভাইয়ের নামটা যেন কী?
সুরমা বললেন, বিনু।
বিনু গম্ভীর গলায় বলল, বিনয়কুমার বসু।
ঠিক ঠিক। হেলাফেলা করে ন্যাড়া বোঁচা একটা নাম বললেই হল? তার সঙ্গে গয়না-টয়নাগুলো। জুড়ে দিতে হবে না? বলে বিনুর দিকে তাকালেন হেমনাথ। কৌতুকে তার চোখ ঝকমক করছে। বললেন, আমার ইচ্ছে, নামটা একেবারে জেনারেলিসিমো বিনয়কুমার বসু হোক। কি, পছন্দ তো?
জেনারেলিসিমো শব্দটা বিনুর অজানা। তবু মনে হল, ওটার মধ্যে ঠাট্টা আছে। সে লজ্জা পেয়ে গেল।
হেমনাথ আবার বললেন, দাদাভাইকে তো বীরপুরুষের মতো দেখতে, বাঘ মারতে পার?
বিনু উত্তর দিতে যাচ্ছিল, সুধা হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, বাঘ! জানো দাদু, সেবার ছোটনাগপুরে খরগোশ দেখে ও অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল।
ছোটদিটা চিরকালের বিভীষণ। ঠিক সময়টিতে শত্রুতা করবার জন্য সে যেন ওত পেতেই আছে। বিনুর ইচ্ছা হল, সুধার বেণী ধরে কষে টান লাগিয়ে দেয়। কিন্তু সব দিক বিবেচনা করে সদিচ্ছাটাকে এই মুহূর্তে কাজে লাগানো গেল না। পারলে অবশ্য সুধাকে ভস্মই করে ফেলত। কটমট করে একবার তাকিয়ে আপাতত বিনুকে নীরব থাকতে হল।
হেমনাথ জিজ্ঞেস করলেন, কোন ক্লাসে পড়?
বিনু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই মনে হল, প্যান্ট ধরে কে টানছে। টানটা অনেকক্ষণ ধরেই অবশ্য টের পাওয়া যাচ্ছিল, বিনু খেয়াল করে নি। তলার দিকে তাকাতেই দেখতে পাওয়া গেল। সেই মেয়েটাকোঁকড়া কোকড়া যার চুল, লালচে ফুলো ফুলো গাল, রুপোর কাজললতার মতো চোখ-ঘোট মুঠিতে শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে তার প্যান্টের নিচের দিকটা ধরে আছে।
চোখাচোখি হতেই মেয়েটা আরও জোরে টান লাগাল। ফিসফিসিয়ে বলল, নামো, নামো বলছি।
হেমনাথ বোধ হয় লক্ষ করেছিলেন। গলার স্বরে লম্বা টান দিয়ে বললেন, ওরে হিংসুটে, দাদাকে নামতে বলা হচ্ছে!
আগের মতো সুর করে মেয়েটা এবার হেমনাথকে বলল, ওকে নামিয়ে দাও, শিগগির নামিয়ে দাও–
হেমনাথ বললেন, কেন, নামাব কেন?
বিনুর প্যান্ট ধরে মেয়েটা টানছিলই। বলল, আমি তোমার কোলে উঠব।
দুষ্ট বদমাশ মেয়ে, আমার কোলটা একেবারে মৌরুসিপাট্টা করে নিয়েছ!
মেয়েটা কী বুঝল, সে-ই জানে। জোরে জোরে চুল ঝাঁকিয়ে সমানে বলতে লাগল, নামিয়ে দাও, নামিয়ে দাও–
সুধা-সুনীতি-সুরমা-অবনীমোহন, সবাই সকৌতুকে দেখছিলেন। সুরমা বললেন, মেয়েটা কে গো মামা? এতক্ষণ খেয়াল করি নি–এক্কেবারে জাপানি পুতুল। আর কেমন পুটুর পুটুর কথা বলছে।
ওর নাম ঝিনুক। হেমনাথ বললেন, ভবতোষকে তোর মনে আছে?
কোন ভবতোষ?
লাহিড়ীবাড়ির ভবতোষ। রাজেন লাহিড়ীর ছেলে।
চোখ কুঁচকে ভাবতে চেষ্টা করলেন সুরমা। স্মৃতির ঝাঁপি খুলতে পারলেন কিনা, বোঝা গেল না। অনিশ্চিতভাবে বললেন, নামটা চেনা চেনা লাগছে, মুখটা মনে করতে পারছি না। কতকাল আগে রাজদিয়াতে এসেছিলাম, সে কি আজকের কথা!
হেমনাথ বললেন, ঝিনুক ভবতোষের মেয়ে।
সুরমা কোমল গলায় ডাকলেন, এস ঝিনুক, আমার কাছে এস।
তোমার কাছে যাব না। জেদী স্বরে বায়না জুড়ে দিল ঝিনুক, আমি দাদুর কোলে উঠব, দাদুর কোলে উঠব।
এই মনোরম ছেলেমানুষির খেলাটা আরও কিছুক্ষণ হয়তো চলত। কিন্তু তার আগেই হিন্দুস্থানী কুলিরা চেঁচিয়ে উঠল, চলিয়ে বাবুজি, বহুত দের হো যাতা– সুরমারা হেমনাথকে দেখে দাঁড়িয়ে যেতে কুলিরাও দাঁড়িয়ে পড়েছিল। এখন তারা অস্থির হয়ে উঠেছে।
হেমনাথ যেন এতক্ষণে স্থান-কাল সম্বন্ধে সচেতন হয়ে উঠলেন, ওই দেখ, জেটিঘাটে দাঁড়িয়েই গল্প জুড়ে দিয়েছি। চল চল–আস্তে আস্তে তিনি বিনুকে নামিয়ে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে কাণ্ডটা ঘটল, লাফ দিয়ে ঝিনুক তার কোলটি দখল করে বসল। তারপর বিজয়িনীর মতো সগর্বে একবার বিনুর দিকে তাকাল।
বিনুর ইচ্ছা হল, পা ধরে টেনে মেয়েটাকে নামিয়ে দেয়। অস্পষ্টভাবে মনে হল, দাদুকে খুব সহজে দখল করা যাবে না।
ঝিনুককে কোলে নিয়েই চলতে শুরু করলেন হেমনাথ। বিরক্ত গলায় বললেন, তোকে নিয়ে আর পারি না ঝিনুক- হেমনাথের বিরক্তি যে স্নেহেরই আরেক নাম তা বলে দিতে হয় না।
হেমনাথ আগে আগে চলেছেন। সুরমারা তার পিছু পিছু এগুতে লাগলেন।
যেতে যেতে হেমনাথ পেছন ফিরলেন। আলতো গলায় ডাকলেন, রমু–
কী বলছ মামা? সুরমা উৎসুক চোখে তাকালেন।