সুরমা খুব আস্তে আস্তে পা ফেলছিলেন। চলতে চলতে বৃদ্ধটির কাছে এসে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। একটুক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে ঝকে তার পা ছুঁলেন।
বৃদ্ধের চোখ আলো হয়ে উঠল। তাড়াতাড়ি সুরমাকে তুলে চিবুকে হাত রেখে বললেন, আমার রমু না?
হ্যাঁ, মামা। সুরমা মাথা নাড়লেন।
বিনু এই প্রথম জানতে পারল, একটা আদরের নাম আছে মা’র-রমু।
বৃদ্ধ বললেন, আসতে পারলি তবে! কত বছর ধরে চিঠি লিখছি। তার স্বরে স্নেহের সঙ্গে অনুযোগ মেশানো।
কী করব বল– সুরমা বললেন, কত রকম ঝামেলা ঝামেলা—
তো হিল্লিদিল্লি যাস কী করে? এখানে আসতেই যত কষ্ট!
অস্ফুট গলায় সুরমা কী একটা উত্তর দিলেন, কেউ শুনতে পেল না।
বৃদ্ধ বললেন, কতকাল পর তোকে দেখলাম। সেই বিয়ের সময় শেষ দেখা। তখন তুই একেবারে ছেলেমানুষ। ক’বছর বয়েসে যেন বিয়ে হয়েছিল তোর?
লাজুক সুরে সুরমা বললেন, সতের।
বৃদ্ধ বললেন, সে কি আজকের কথা! তুই নিজে এসে না বললে চিনতেই পারতাম না। মুখের আদল টাদল, চেহারা, কত বদলে গেছে।
সুরমা হাসলেন।
বৃদ্ধ আবার বললেন, স্টিমার থেকে কত লোক নেমে গেল কিন্তু কেউ আমার কাছে দাঁড়াচ্ছে না। এত লোকের ভিড়ে কে যে আমার রমু বুঝতে পারছি না। একবার তো ভাবলাম, তোরা এবারও এলি না। বলতে বলতে হঠাৎ সচেতন হয়ে উঠলেন যেন, তোর চেহারার এ কী হাল হয়েছে!
সুরমা মলিন হাসলেন, ক’বছর ধরে সমানে ভুগছি। ছোট ছেলেটা হবার পর থেকে শরীর একেবারে ভেঙে গেছে। নিজেও সে বাঁচল না, আমাকেও জন্মের মতো পঙ্গু করে রেখে গেল।
ইস, কী স্বাস্থ্য ছিল আর কী দাঁড়িয়েছে! ক’খানা শুকনো হাড় ছাড়া কিছুই তো নেই। তা বাপু এই যে এলে, শরীর টরীর সারিয়ে নাও। তারপর যাবার কথা মুখে আনবে।
সুরমা কিছু বললেন না। মৃদু একটু হাসি তার মুখে আবছাভাবে লেগে রইল।
বিনু বুঝে ফেলেছে, এই বুড়ো মানুষটিই তার দাদু। চিঠি পড়ে দাদুর নামটা সে জেনেছে হেমনাথ মিত্র।
হেমনাথ হঠাৎ অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, ওই দেখ, কী ভুলো মন আমার। মেয়েকে নিয়েই মেতে আছি। অবনীমোহন কোথায়? আমার দাদা আর দিদিভাইরা?
অবনীমোহন সামনে এগিয়ে এসে প্রণাম করলেন। হেমনাথ বললেন, বেঁচে থাকো বাবা, শতায়ু হও।
অবনীমোহন বললেন, আপনার শরীর কেমন আছে মামাবাবু?
খুব ভাল। অসুখ বিসুখ আমার কাছে বড় একটা ঘেঁষে না। লাস্ট টেন ইয়ারসে দু’বার মোটে জ্বর হয়েছিল। তার আগে কিছু হয়েছিল কিনা, মনে নেই। সে যাক, তোমরা কেমন আছ বল।
আমরা খুব খারাপ নেই, তবে আপনার ভাগনীকে নিয়ে বিপদে পড়েছি।
তা তো দেখতেই পাচ্ছি।
অবনীমোহন কিছু বললেন না।
হেমনাথ বললেন, রাস্তায় আসতে কষ্ট-টষ্ট হয় নি তো?
ট্রেনে ভালই এসেছিলেম। তবে স্টিমার চড়ায় ঠেকে যাওয়ায় ঘন্টাকয়েক আটকে থাকতে হয়েছিল।
হেমনাথ বললেন, কাল একবার স্টিমারঘাটে এসেছিলাম, চড়ায় আটকাবার কথা শুনে গেছি। সুজনগঞ্জের ভাটিতে ক’বছর ধরে মস্ত চর পড়ছে। প্রায়ই স্টিমার ওখানে আটকে যায়।
একটু কী ভেবে অবনীমোহন বললেন, মামীমা কেমন আছেন?
সুরমা এতক্ষণ চুপ করে ছিলেন। তার স্বভাবের রং মৃদু। খুব আস্তে আস্তে আধফোঁটা, আধবোজা গলায় কথা বলেন। নিজের দুর্বল শরীর, ক্ষীণ জীবনীশক্তি, সব ভুলে গিয়ে এখন প্রায় চেঁচামেচিই শুরু করলেন, তাই তো, মামীমাকে দেখতে পাচ্ছি না। স্টিমারঘাটে এল না যে! শরীর খারাপ হয় নি তো?
না, ভালই আছে। হেমনাথ বললেন, তোরা আসবি, তাই ভোরবেলা উঠেই রান্নবান্না নিয়ে মেতেছে। বলতে বলতে হঠাৎ কী লক্ষ করে বললেন, এ কি অবনী!
হেমনাথের স্বরে বিস্ময় ছিল। অবাক হয়ে অবনীমোহন বললেন, আজ্ঞে–
তোমার চুল এর ভেতরেই পাকতে শুরু করেছে দেখছি। এটা কিরকম হল!
“আজ্ঞে, পঞ্চাশ বছর প্রায় পেরুতে চলোম–
“উঁহু উঁহু, যত বয়েসই হোক, বাপ-খুড়ো মামা-জেঠা, গুরুজনরা বেঁচে থাকতে ছেলেমেয়েদের চুল পাকতে নেই।
অবনীমোহন নিঃশব্দে হাসলেন। অন্যরাও হেসে উঠল।
হেমনাথ কী বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই সুরমা বলে উঠলেন, মামা, তুমি কিন্তু মেয়ে-জামাই পেয়ে সব ভুলে গেছ। তোমার দাদা আর দিদিভাইরা–
হেমনাথ ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, আরে তাই তো। কোথায় ওরা?
সুধা আর সুনীতি এগিয়ে এসে প্রায় একই সঙ্গে প্রণাম করল।
পায়ের কাছ থেকে উঠে দাঁড়াতেই আঙুলের ডগায় দু’জনের মুখ তুলে ধরে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কিছুক্ষণ দেখলেন হেমনাথ। তারপর মুগ্ধ গলায় বললেন, বাঃ বাঃ! তুমি নিশ্চয়ই সুধাদিদি আর তুমি সুনীতিদিদি।
হেমনাথ ঠিক ঠিক চিনতে পেরেছেন। বাইশ চব্বিশ বছর দেখাসাক্ষাৎ ছিল না, তবে চিঠিপত্রে ভাগনীর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। নিজের সন্তানদের কে কিরকম দেখতে হয়েছে, কার স্বভাব কেমন, পড়াশোনায় কে ভাল কে মন্দ, সব কথা মামাকে জানানো চাই সুরমার।
সুধা বলল, হ্যাঁ, আমি সুধাই। সুনীতি বলল, আমি সুনীতি। কিন্তু চিনলেন কেমন করে?
হেমনাথ বললেন, সে একটা মন্তর আছে, তাই দিয়ে চিনে ফেলেছি। আঙুলের প্রান্তে চিবুক ধরাই ছিল। হঠাৎ চোখে মুখে দুর্ভাবনার রেখা ফুটিয়ে হেমনাথ বললেন, তোমরা এসেছ, এর চাইতে আনন্দের আর কিছু নেই। কিন্তু দিদিভাইরা, একটা মুশকিলে ফেলে দিলে যে।
কী মুশকিল দাদু? সুনীতিকে ঈষৎ উদ্বিগ্ন দেখাল।
তোমার হলে দু’জন, আর ঘরে আছেন একজন। এই তিনজনের ভেতর এখন কাকে যে পাটরানী করি! শেষ পর্যন্ত একটা গৃহযুদ্ধ না বেধে যায়।