বিনুরা কিন্তু এখনও রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কাছাকাছি আসতে পাড়টা পরিষ্কার দেখা গেল। জেটিঘাটের ডান দিকে নৌকোঘাট। ছইওলা প্রকান্ড প্রকান্ড কত যে নৌকো লগি পুঁতে সারি দাঁড়িয়ে রয়েছে! এক সঙ্গে এত নৌকো আর এত বড় বড় নৌকো আগে কখনও দেখে নি বিনু। ওপরে উঁচু বাঁধের মতো রাস্তায় চেরা বাঁশের বেড়া আর টিনের চালের অগুনতি দোকান। কিসের দোকান বোঝা যাচ্ছে না। লোকজন, কদাচিৎ দু’একটা সাইকেল চোখে পড়ছে।
সুধা অস্থির হয়ে উঠল, সবাই নেমে গেল। বাবা, আমরা স্টিমারে পড়ে থাকব নাকি?
চাইলেও থাকতে দেবে না রে। অবনীমোহন হাসলেন, একটু দাঁড়া, হুড়োহুড়িটা কমুক। তারপর নামব।
স্টিমার ফাঁকা হয়ে এলে বিনুদের নিয়ে কেবিনে ফিরলেন অবনীমোহন। সুরমা নিজের বিছানায় বসে আছেন। চোখ দুটি জানালার বাইরে ফেরানো। কখন তার ঘুম ভেঙেছে, টের পাওয়া যায়নি।
সুরমা সুধা সুনীতি আর বিনুর মা। বয়স চল্লিশ বেয়াল্লিশ, এক-আধ বছর বেশিও হতে পারে। তিনি যে সুধা সুনীতির মা, বলে দিতে হয় না। পানপাতার মতো অবিকল সেই মুখ, সেই রকম টানা টানা চোখ, থাক থাক কোঁচকানো চুল, উঁচলো চিবুকে তেমনি ভাজ। নিজের চেহারার নিজের সুষমার সবটুকুই অকাতরে তিনি মেয়েদের দিয়ে দিয়েছেন, আলাদা করে কিছুই রাখেন নি। একটা জিনিসই শুধু তার নেই যা সুধা সুনীতির আছে, সেটা স্বাস্থ্য।
জ্ঞান হবার পর থেকে মা’কে কোনওদিন সম্পূর্ণ সুস্থ দেখে নি বিনু। সারাদিনই প্রায় শুয়ে থাকেন। হাঁটাহাঁটি, সংসারের কাজকর্ম, সব বারণ। কথা বলতে কষ্ট হয়। এক-আধটু যাও বলেন তা ফিসফিসিয়ে, আধফোঁটা গলায়। গায়ে মাংস নেই, হাত-পা আর কণ্ঠার হাড় বেরিয়ে পড়েছে। রোগা দুর্বল শরীরে রেখাময়, শিথিল চামড়া। গায়ের রং একসময় ছিল পাকা সোনা, এখন মোমের মতো ফ্যাকাসে। চোখের কোলে রক্তের লেশ নেই, কাগজের মতো তা সাদা। দৃষ্টি কেমন যেন ক্লান্ত, দীপ্তিহীন। তাকিয়ে থাকতেও তার বুঝি কষ্ট হয়। সুরমাকে ঘিরে জীবনের এতটুকু লাবণ্যও আর ঝলমল করে না, তার সব আলো সব আভা নিবে গেছে।
বিনু শুনেছে, তার জন্মের এক বছর পর একটা ভাই হয়েছিল। দু’মাসের বেশি সে বাঁচে নি। নিজেও মরেছে, মাকেও মেরে রেখে গেছে। অনেক দিন ভুগবার জন্যই বোধ হয় মা’র ওপর গাঢ় মলিন ছায়া অনড়।
স্ত্রীকে ভাল করে দেখে নিয়ে অবনীমোহন বললেন, এ কী!
কী বলছ! জানালার বাইরে থেকে চোখ দুটি ভেতরে নিয়ে এলেন সুরমা।
মুখটুখ ধুয়েছ দেখছি, জল পেলে কোথায়?
কেবিনে জলের ব্যবস্থা নেই। তার জন্য অনেকটা ঘুরে ইঞ্জিন-ঘরের কাছে যেতে হয়। সুরমা জানালেন, সেখান থেকেই হাতমুখ ধুয়ে এসেছেন।
বকুনির সুরে অবনীমোহন বললেন, একা একা অতটা রাস্তা তোমার যাওয়া উচিত হয় নি। দুর্বল শরীর, পড়ে উড়ে গেলে এক কান্ডই হত।
সুরমা বললেন, আজ আমার শরীর খুব ভাল লাগছে। জানো, এতখানি গেছি এতখানি এসেছি, কিন্তু একটুও হাঁপাই নি।
অর্ধেক আনন্দের সঙ্গে অর্ধেক বিস্ময় মিশিয়ে অবনীমোহন বললেন, সত্যি বলছ?
হ্যাঁ, সত্যি।
যাক, পা দিতে না দিতেই রাজদিয়া টনিকের কাজ শুরু করে দিয়েছে। তোমার স্বাস্থ্য ফেরাবার জন্যে কত জায়গায় নিয়ে গেছি, কিছুই হয় নি। রাজদিয়া যদি তোমাকে আগের মতো সুস্থ করে দেয়, বুঝব এমন জায়গা পৃথিবীতে নেই।
সুরমা বোধ হয় অবনীমোহনের কথা শুনতে পেলেন না। আপন মনে বললেন, কত কাল পর এখানে এলাম। কী ভাল যে লাগছে! তার ছায়াচ্ছন্ন, ক্লান্ত চোখে একটুখানি আলো যেন ফুটি ফুটি করছে।
ধীরে সুস্থে জিনিসপত্র গুছিয়ে দুটো কুলি ঠিক করলেন অবনীমোহন, তাদের জিম্মায় সেসব দিয়ে স্ত্রীর দিকে ফিরলেন, অনেকখানি যেতে হবে, তোমার হাত ধরে নিয়ে যাই?
সুরমা বললেন, হাত ধরতে হবে না, আমি এমনিই যেতে পারব।
ঠিক পারবে তো?
হ্যাঁ, গো, হ্যাঁ।
আগে আগে সুরমা চললেন, তারপর সুধা সুনীতি, একেবারে শেষে অবনীমোহন। আর বিনু।
একটু পর গ্যাংওয়ে পেরিয়ে সবাই জেটিতে এসে পড়ল। জেটিঘাটের ভিড় এখন হালকা হয়ে গেছে। দু’চারটি উৎসুক মুখ শুধু এদিকে সেদিকে ছড়ানো। বিনু চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারদিক দেখতে লাগল। যে অল্প ক’টি লোক এখনও রয়েছে তার ভেতর কোন মানুষটি দাদু, বুঝতে পারা যাচ্ছে না। আদৌ তিনি এসেছেন কিনা, কে জানে।
বেশি দূর যেতে হল না। জেটিঘাটের মাঝামাঝি আসতে চোখে পড়ল, একজন বৃদ্ধ উন্মুখ হয়ে প্রতিটি যাত্রীকে লক্ষ করছেন। তাঁর পাশে আট ন’ বছরের ছোট একটি মেয়ে।
বুড়ো মানুষটির গায়ের রং কালো। মাঝারি চেহারা, মাথাটা বকের পাখার মতো ধবধবে, মুখময় তিন চারদিনের জমানো দাড়ি। এত বয়সেও মেরুদণ্ড একেবারে সোজা। দু’চোখ স্নেহের রসে যেন ভাসো ভাসো, এখন অবশ্য কিছুটা উক্তষ্ঠিত। চুলের রং বদল, শরীরে কিছু ভার নামানো আর চামড়ায় এলোমেলো আঁচড় কাটা ছাড়া সময় তেমন কিছুই করে উঠতে পারে নি। এত বয়সেও শরীর বেশ শক্তই আছে। স্বাস্থ্যের ভিত রীতিমতো মজবুত। বৃদ্ধকে ঘিরে এমন এক সরলতা মাখানো যাতে মনে হয়, তার বয়স্ক দেহের ভেতর চিরকালের এক শিশুর বাস। পরনে খাটো ধুতি, খদ্দরের ফতুয়া, পায়ে লাল ক্যাম্বিসের জুতো।
ছোট মেয়েটির চুল কোঁকড়া কোঁকড়া। নাকটি একটু বোচাই হবে। ফুলো ফুলো নরম লালচে গাল। রুপোর কাজললতার মতো চোখের কালো মণি দু’টো টলটল করছে। একটু নাড়া দিলেই টুপ করে ঝরে পড়বে। নীল ফ্রক লাল জুতোয়, মনে হয়, মোমের পুতুলটি।