আবছা গলায় বিনু জিজ্ঞেস করল, কী?
যদি তুমি ওকে বিয়ে কর, সমস্যাটা মিটতে পারে। কিন্তু আত্মীয়রা তোমাদের ত্যাগ করবে। তা ছাড়া, এমন একটা মেয়েকে বিয়ে করার সাহস কি তোমার আছে?
বিনুর মনে হল, তার চারপাশের সমস্ত পৃথিবী ধসে পড়ছে। বিষবাষ্পে-ভরা পূর্ব বাংলা থেকে কী নিদারুণ আতঙ্কের মধ্যে ঝিনুককে সীমান্তের এপারে নিয়ে এসেছে, শুধু সে-ই জানে। কিন্তু অবনীমোহন তাকে জীবনের সবচেয়ে কঠিন, সবচেয়ে দুরূহ সংকটের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। বিপন্ন, দ্বিধাগ্রস্ত, শ্বাসরুদ্ধ বিনু কী জবাব দেবে, ভেবে পেল না।
অবনীমোহন বললেন, একটা কথা ভেবে দেখতে পার। এ জাতীয় মেয়েদের জন্যে গভর্নমেন্টের হোম’ আছে। সেখানে আপাতত ঝিনুককে রাখা যেতে পারে।
বিনু এবারও চুপ।
অবনীমোহন বলতে লাগলেন, তুমি ঝিনুকের কাছে যাও। এক্ষুনি নয়, সময় নিয়ে বুঝিয়ে সুঝিয়ে হোম’-এর ব্যাপারটা বলল।
শরীর এবং মন কঠিন আঘাতে অসাড় হয়ে গেছে। নিজেকে ধীরে ধীরে টেনে তুলল বিনু। পাশের ঘরে এসে দেখল, সেটা একেবারে ফাঁকা। সে ডাকতে লাগল, ঝিনুক-ঝিনুক।
সাড়া নেই।
তেতলার অন্য ঘরগুলো আতিপাতি করে খুঁজল বিনু। কোথাও ঝিনুককে পাওয়া গেল না। সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে দোতলায়, তারপর একতলায় নেমে এল সে। ঝিনুক কোথাও নেই।
একতলার কিচেনে রান্না করছিল খগেন। তাকে জিজ্ঞেস করল, ঝিনুককে দেখেছে কিনা। খগেন জানালো, রান্নাবান্না নিয়ে সে ব্যস্ত ছিল। দিদিমণিকে লক্ষ করে নি।
অবনীমোহন ঝিনুককে পাশের ঘরে যেতে বলেছিলেন। নিশ্চয়ই সে সেখানে যায় নি। দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে অবনীমোহনের কথাগুলো শুনেছে। বিনুর শাসক্রিয়া বন্ধ হয়ে এসেছে। সে সদর দরজার দিকে দৌড়ল। সেটা হাট করে খোলা। বাইরে বেরিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো ঝিনুককে ডাকতে ডাকতে প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের এক মাথা থেকে অন্য প্রান্তে ছুটতে লাগল। তারপর চলে এল ট্রাম রাস্তায়। নেই, নেই, নেই। যেদিকে যতদূর নজর যায়, অবিরল গাড়ির স্রোত। ভিড়, ভিড় আর ভিড়। তার মধ্যে চিরদুঃখী মেয়েটাকে কোথাও দেখা গেল না।
অঘ্রাণ মাস পড়ে গেছে। কুয়াশায় চারদিক ঝাঁপসা। উত্তরে বাতাসে গাঢ় হয়ে হিম মিশে যাচ্ছে।
কুহেলিবিলীন আকাশের নিচে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বিনু।
॥ তৃতীয় ও শেষ পর্ব সমাপ্ত ॥