অন্য দিকের দেওয়ালগুলোর পাশে ভারী ভারী আলমারি, একটা মাঝারি লোহার সিন্দুক, ড্রেসিং টেবল, কটা চেয়ারও রয়েছে।
কয়েক পলক বিনুর দিকে তাকিয়ে রইলেন অবনীমোহন। কৈশোরে যে ছেলেকে শেষ দেখেছেন, সে এখন পূর্ণ যুবক। তবু চিনতে অসুবিধা হল না। মৃদু হাসি ফুটল তার মুখে। নির্লিপ্ত সুরে বললেন, এস– দূরের চেয়ারগুলো দেখালেন, ওখান থেকে দুটো নিয়ে এসে কাছে বসো।
বিনু আর ঝিনুক অবনীমোহনকে প্রণাম করে চেয়ার টেনে এনে বসল। বিনু লক্ষ করেছে, হেমনলিনীর মতো পা সরিয়ে নেন নি অবনীমোহন। অর্থাৎ ঝিনুক তার কাছে অচ্ছুৎ নয়। আশান্বিত হয়ে ওঠে বিনু।
অবনীমোহন বললেন, সন্ধের একটু আগে হিরণ এসেছিল। তার মুখে তোমাদের সম্বন্ধে সব শুনলাম। ভেবেছিলাম, দু’একদিন পরে আসবে। হঠাৎ কী খেয়াল হতে জোরে জোরে ডাকতে লাগলেন, খগেন–খগেন–
সেই মাঝবয়সী লোকটা তেতলায় বিনুদের পৌঁছে দিয়ে চলে গিয়েছিল। আবার ফিরে এল। অবনীমোহন তাকে বললেন, ওরা রাত্তিরে খাবে। তার ব্যবস্থা করো–
আচ্ছা– খগেন চলে গেল।
অবনীমোহন এবার বিনুর দিকে তাকালেন, খবরের কাগজে পড়ি পাকিস্তানের অবস্থা খুব খারাপ। দলে দলে রিফিউজি চলে আসছে। তোমরা এসে ভাল করেছ। তোমার হেমদাদু আর দিদাদের নিয়ে এলে না কেন?
ওঁরা এলেন না। না আসার কারণ জানিয়ে দিল বিনু।
কিছুক্ষণ নীরবতা।
তারপর অবনীমোহন বললেন, তুমি নিশ্চয়ই অনেক আশা নিয়ে আমার কাছে চলে এসেছ। কিন্তু আমি কী অবস্থায় আছি, সেটা কি জানো?
বিনু বলল, কিছু কিছু শুনেছি।
কিছু কিছু নয়, সবটাই তোমার জানা দরকার।
অবনীমোহন শুরু করলেন। রাজদিয়া থেকে আসামে গিয়ে কনট্রাক্টরি করে দু’হাতে অঢেল টাকা রোজগার করেছিলেন। যুদ্ধ শেষ হলে কলকাতায় চলে আসেন। তখন ব্যাঙের ছাতার মতো অসংখ্য ব্যাঙ্ক গজিয়েছে। তার একটায় তার সমস্ত টাকা জমা রেখেছিলেন। সেই ব্যাঙ্কের মালিকরা রাতারাতি লাল বাতি জ্বালিয়ে সব টাকা নিয়ে উধাও হয়ে যায়। আরও অনেকের মতো সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েন অবনীমোহন। তবু নতুন করে ঘুরে দাঁড়াবার চেষ্টা করেছেন। বাড়ি মর্টগেজ দিয়ে এবং নানা জায়গা থেকে কিছু টাকা যোগাড় করে ফের অন্য ব্যবসা আরম্ভ করেছিলেন। কিন্তু সেখানেও ডাহা ফেল। তার মাথায় এখন বিপুল ঋণের বোঝা।
নতুন ব্যবসাটা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় তার সমস্ত উদ্যম, মনের জোর একেবারে ধ্বংস হয়ে গেছে। মেরুদণ্ড ভেঙে চুরমার। আশাহীন, বিপর্যস্ত অবনীমোহন তখন উদভ্রান্তের মতো এখানে ওখানে ছুটছেন, কী করবেন বুঝতে পারছেন না। সেই সময় অপার শান্তির সন্ধান পেলেন।
জটাধারী সেই সাধুর ফোটোটার দিকে আঙুল বাড়িয়ে অবনীমোহন বললেন, হঠাৎ একজন এঁর খোঁজ দিল। যোশিমঠে গিয়ে দর্শন পেলাম। এঁর কাছে দীক্ষা নিয়েছি। আর কোনও দুঃখ নেই। টাকাপয়সা দু’দিনের মোহ মাত্র। সে সব নিয়ে এখন আর ভাবি না। জীবনে কোনটা লাভ, কোনটা লোকশান, গুরুদেব চোখে আঙুল দিয়ে তা বুঝিয়ে দিয়েছেন।
অনন্ত বিস্ময়ে বাবাকে দেখছিল বিনু। এই কি তার আজন্মের চেনা অবনীমোহন! কখনও এক জায়গায় স্থিত হন নি। কত কী-ই না করে বেড়িয়েছেন! ব্যবসা, অধ্যাপনা, সুদূর পূর্ব বাংলায় জমিজমা কিনে চাষবাস। যুদ্ধের আমলে আসামে গিয়ে কনট্রাক্টরি। ফের ব্যবসা। ঝুঁকির পর ঝুঁকি। অ্যাডভেঞ্চারের পর অ্যাডভেঞ্চার। নির্বিঘ্ন, ঝঞ্ঝাহীন, এমন কোনও কিছুর প্রতি বিন্দুমাত্র আকর্ষণ ছিল না। সেই অবনীমোহন কিনা শেষ জীবনে শান্তির সন্ধানে গুরুদেবের পদতলে আশ্রয় নিয়েছেন!
অবনীমোহন বলতে লাগলেন, আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি বিনু–
কী সিদ্ধান্ত?
আমার ঋণ সুদে আসলে বিরাট হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের এই বাড়িটা বিক্রি করলে সেই ঋণ শোধ হয়ে হাতে কিছু টাকা থাকবে। ভেবেছিলাম, আমি তাই নিয়ে গুরুদেবের আশ্রমে চলে যাব। কিন্তু তুমি এসে পড়েছ। নিশ্চয়ই ওপার থেকে কিছু আনতে পার নি। সেই টাকার অর্ধেকটা তোমাকে দেব।
বিনুর মাথায় সমস্ত সৌরলোক খান খান হয়ে ভেঙে পড়ে। এই বাড়ি বেচে দিলে ঝিনুককে নিয়ে কোথায় থাকবে সে? রুদ্ধশ্বাসে বলল, বাড়িটা কি কোনওভাবেই বাঁচানো যায় না বাবা?
অসম্ভব। অঋণী থেকেই আমি মরতে চাই।
ঘরের ভেতর হঠাৎ অন্তহীন নৈঃশব্দ নেমে আসে।
একসময় অবনীমোহন বলেন, হিরণের মুখে শুনলাম, তুমি একটা চাকরি পেয়েছ।
বিনু বলল, হ্যাঁ। আনন্দদা কাজটা যোগাড় করে দিয়েছেন। আসছে মাসে জয়েন করব।
এটা ভাল খবর। একটু চিন্তা করে অবনীমোহন বললেন, তোমার সঙ্গে আমার একটা দরকারী কথা আছে। সেটা তোমাকেই শুধু বলতে চাই। ঝিনুক, তুমি পাশের ঘরে যাও। ওখানে খাট বিছানা চেয়ার টেয়ার সবই আছে।
নতমুখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ঝিনুক।
অবনীমোহন সোজাসুজি ছেলের চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ঝিনুকের খবরটা অনেক আগেই আমি পেয়েছি। ভীষণ দুঃখজনক ঘটনা। শুনে খুব কষ্ট হয়েছিল। কিন্তু
নীরবে বাবাকে লক্ষ করতে থাকে বিনু।
অবনীমোহন থামেন নি, ঝিনুককে যে পাকিস্তান থেকে আনলে, ওকে নিয়ে কী করবে ভেবেছ?
ঠিক এই ধরনের প্রশ্ন সেদিন ঝুমাও করেছিল। বিনুর বুকের ভেতরটা আমূল কেঁপে যায়। সে উত্তর দেয় না।
অবনীমোহন সমানে বলে যান, কোনও আত্মীয়স্বজন এমন মেয়েকে শেলটার দেবে কিনা সন্দেহ। তুমি যদি আলাদা বাড়ি ভাড়া করে ওকে নিজের কাছে রাখতে চাও, হাজারটা প্রশ্ন উঠবে। লোকে জানতে চাইবে মেয়েটা কে। তোমার সঙ্গে তার কী সম্পর্ক? কী জবাব দেবে তখন? শুধু একটা পথ খোলা আছে–