.
৩.৪০
আরও সপ্তাহখানেক বাদে সন্ধেবেলায়, ভীষণ ব্যস্তভাবে অফিস থেকে ফিরে এল হিরণ।
অন্য সব দিন তাকে লঘু মেজাজে দেখা গেছে। হাসিখুশি, আমুদে। ফিরেই সুধা আর ঝিনুককে নিয়ে চা খেতে খেতে জমজমাট আসর বসিয়ে দিত। অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা, হইচই, মজার মজার গল্প। ছুটির দিনে কোথায় বেড়াতে যাবে তার পরিকল্পনা।
আজ হিরণকে অন্যরকম দেখাচ্ছে। কেমন যেন চিন্তাগ্রস্ত, চোখে মুখে অস্থিরতার ছাপ।
বিনুরা তার পরিবর্তনটা লক্ষ করেছিল। সুধা জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে? তোমাকে আজ এরকম দেখাচ্ছে কেন?
হিরণ জানায়, মাঝে মাঝে সে যেমন অফিস ছুটির পর ভবানীপুরে যায়, তেমনি আজও গিয়েছিল। অবনীমোহন উত্তরকাশী, আলমোড়া, হরিদ্বার, নানা তীর্থস্থান ঘুরে কাল কলকাতায় ফিরে এসেছেন। ধর্মের দিকে ঝোকার পর গুরুর কাছে দীক্ষা নিয়েছিলেন। তখন থেকেই সংসারের সঙ্গে তার সম্পর্ক আলগা হয়ে গিয়েছিল। এবার যেন পার্থিব সমস্ত ব্যাপারে তাকে আরও বেশি উদাসীন মনে হয়েছে হিরণের। ঝিনুক আর বিনুর কথা জানাতে তাদের ভবানীপুরে পাঠিয়ে দিতে বলেছেন। কিন্তু সেই বলার মধ্যে উচ্ছ্বাস নেই। বেশ ক’বছর বাদে ছেলের সঙ্গে দেখা হবে, অথচ তাকে কেমন যেন অবেগশূন্য মনে হল। এটাই হিরণকে ভাবিয়ে তুলেছে।
হিরণ জিজ্ঞেস করল, কবে ভবানীপুরে যেতে চাও?
বিনু ভেতরে ভেতরে ব্যকুল হয়ে উঠেছিল। বলল, এখনই যাব।
হিরণ এবং সুধা বুঝতে পারছে, অবনীমোহনের কাছে যাওয়াটা বিনুদের পক্ষে কতটা জরুরি। কেউ বাধা দিল না।
সুধা বলল, তা হলে চল। আমরা তোদের পৌঁছে দিয়ে আসি। বাবার সঙ্গেও অনেক দিন বাদে দেখা হবে।
অবনীমোহনের সঙ্গে ঝিনুককে নিয়ে একাই দেখা করতে চায় বিনু। বাবা কতখানি বদলে গেছেন, ঝিনুকের সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করবেন, কিছুই অনুমান করা যাচ্ছে না। অবনীমোহন হয়তো সরাসরি ঝিনুক সম্পর্কে কিছু বলবেন। তারও কিছু বলার থাকবে। সুধা এবং হিরণ তার অত্যন্ত আপনজন, তবু আজ তাদের সঙ্গে আর কেউ থাকুক, সেটা মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়।
বিনু বলল, তোরা কাল যাস। আমি ঝিনুককে নিয়ে গিয়ে আগে বাবার সঙ্গে কথা বলি–
তার মনোভাবটা আঁচ করে নিয়েছিল হিরণ। সুধা কী বলতে যাচ্ছিল, তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ওরাই যাক–
স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে সুধা কী অনুমান করে নিল। আর কিছু বলল না।
দ্রুত পোশাক পালটে, ব্যাগে জামাকাপড় গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল বিনু আর ঝিনুক। হিরণ বড় রাস্তা পর্যন্ত এসে ওদের ট্রামে তুলে দিয়ে গেল।
জোড়া সিটে পাশাপাশি বসে ছিল বিনুরা। প্রায় ফাঁকা ট্রাম চাকায় ধাতব আওয়াজ তুলে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলেছে। বাইরে রাতের কলকাতার নানা দৃশ্য। আলো। ভিড়। বড় বড় বাড়ি। উঁচু উঁচু গাছ। পাশ দিয়ে সাঁই সাঁই ছুটে যাওয়া অজস্র গাড়ি ঘোড়া।
ঝিনুক কথা বলছিল না। বিনু লক্ষ করল, তার চোখে মুখে ফিরে এসেছে পুরনো উৎকণ্ঠা, ভয়, অস্থিরতা। বলল, অত ভেবো না। সব ঠিক হয়ে যাবে।
এমন ভরসা বিনু আগেও বহুবার দিয়েছে। ঝিনুক উত্তর দিল না।
.
আধ ঘন্টার মধ্যে ভবানীপুরে প্রিয়নাথ মল্লিক রোডে সেই তেতলা বাড়িটায় পৌঁছে গেল বিনুরা।
কুড়ি বাইশ দিন আগে ঘোড়ার গাড়িতে চেপে শিয়ালদা স্টেশন থেকে অনেক রাতে এখানে এসেছিল তারা। ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত, দিশেহারা। সেদিন বাড়িটা অন্ধকারে ডুবে ছিল। দরজা-জানালা সব বন্ধ। অদ্ভুত নিঝুম। মনে হচ্ছিল ভুতে-পাওয়া। আজ কিন্তু প্রতিটি ঘরে আলো জ্বলছে। জানালাগুলো খোলা।
সদর দরজা বন্ধ রয়েছে। এটা তাদেরই বাড়ি। তার বাবার তৈরি। তবু দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বিনু অনুভব করল, হৃৎস্পন্দন পলকের জন্য থমকে গেছে। পরক্ষণে প্রায় মরিয়া হয়ে জোরে কড়া নাড়ল সে।
কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে দিল মাঝবয়সী একটা কাজের লোক। পরনে খাটো ধুতি আর আধময়লা ফতুয়া। খুব ছেলেবেলায় একে দেখেছে কি? বিনুর মনে পড়ল না। খুব সম্ভব অবনীমোহন পরে ওকে রেখেছেন।
লোকটা জিজ্ঞেস করল, কাকে চাইছেন?
বিনু বলল, বাবা বাড়ি আছেন?
লোকটা ধন্দে পড়ে গেল, আপনার বাবা! কে তিনি?
বিনু অবনীমোহনের নাম করল।
লোকটা এবার ব্যস্ত হয়ে পড়ে, আসুন আসুন। বাবুর মুখে আপনার কথা শুনিচি। পাকিস্থানে থাকতেন তো?
হ্যাঁ—
লোকটা দরজা বন্ধ করে বিনুদের সঙ্গে নিয়ে একটা লম্বা প্যাসেজ পেরিয়ে ওপরে যাবার সিঁড়ির কাছে চলে এল।
বিনু জিজ্ঞেস করল, বাবা কোথায় আছেন?
তিনতলায়—
সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে চারদিকে তাকাচ্ছিল বিনু। জাতিস্মরের মতো সব কিছু মনে পড়ে যাচ্ছিল তার। কে কোন ঘরে থাকত, কোনটা ড্রইংরুম, কোনটা রান্নাঘর, কোনটা ভাঁড়ার ঘর, কোথায় বসে খাওয়া হত, ইত্যাদি।
লোকটা তাদের প্রকাণ্ড একখানা ঘরে নিয়ে এল। এটা ছিল সুরমা আর অবনীমোহনের ঘর। মা নেই, রাজদিয়ায় চিতাভস্মে কবেই তিনি বিলীন হয়ে গেছেন।
অবনীমোহন দক্ষিণ দিকের দেওয়ালের ধারে একটা বিশাল মেহগনি কাঠের খাটে বসে আছেন। পরনে লুঙ্গির মতো করে পরা থান এবং গেরুয়া পাঞ্জাবি। তার ওপর পাতলা চাদর জড়ানো।
বিনু লক্ষ করল, বাবার চেহারা আগের মতো পাতলা ছিপছিপে নেই। যথেষ্ট মেদ জমেছে। কাঁধ পর্যন্ত লম্বা চুল। মুখ কাঁচাপাকা দাড়িতে ঢাকা। চোখে মুখে শান্ত, সমাহিত একটা ভাব। মনে হয়, অলৌকিক কোনও কিছুর মধ্যে মগ্ন হয়ে আছেন। তাঁর খাটের পাশে উঁচু টেবলে অধোলঙ্গ, বিরাট বিরাট জটাওলা এক সাধুর বড় ফোটো। ফোটোটা ঘিরে ফুলের মালা। সামনে অনেকগুলো ধূপকাঠি জ্বলছে। ধূপের ধোঁয়ায়, ফুলের সুগন্ধে ঘর ভরে আছে।