তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে, পাকিস্তানকে ইসলামিক স্টেট বা মুসলিম রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করা হইয়াছে। কিছুকাল আগে কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলিতে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের সরকারি ভাষা করার দাবি নাকচ করিয়া দেওয়া হইয়াছে। যদিও বাংলা অধিকাংশ পাকিস্তানির মাতৃভাষা।
লিয়াকৎ আলির যুক্তি, যেহেতু পাকিস্তান একটি মুসলিম রাষ্ট্র, সুতরাং ইহার উপযোগী একটি ভাষা প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে উর্দুই সর্বোত্তম। খাজা নাজিমুদ্দিন, সিন্ধু প্রদেশের প্রতিনিধি এন এইচ গজদার প্রমুখ অনেকেই উর্দুর পক্ষে সওয়াল করেন।
পূর্ব পাকিস্তানের ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এবং কংগ্রেসের এস সি চট্টোপাধ্যায় বাংলার পক্ষে বলেন। তাঁহাদের যুক্তি, পাকিস্তানের প্রায় সাত কোটি মানুষের মধ্যে সাড়ে চার কোটি বাংলাভাষী। কাজেই তাহা উপেক্ষা করা উচিত নয়। কিন্তু তাহাদের কথায় পশ্চিম পাকিস্তানের অন্য কেহ কর্ণপাত করিতে চাহেন নাই। তবে পূর্ব পাকিস্তানের তমিজদ্দিন খান বলিয়াছিলেন, ধীরেনবাবু এবং এস সি চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
যাহা হউক, সম্প্রতি বাংলাভাষার প্রতি উপেক্ষায় পূর্ব পাকিস্তানে প্রচণ্ড ক্ষোভের সঞ্চার হইয়াছে। ঢাকায় এবং অন্যান্য ক’টি শহরে তীব্র প্রতিবাদ চলিতেছে। এই প্রতিবাদ শুধু মুসলমানরাই করিতেছে না। হিন্দুদেরও তাহাদের পাশে টানিয়া লইতেছে। আমার বিশ্বাস, খুব শীঘ্রই পূর্ববঙ্গে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির উর্ধ্বে বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্ফুরণ ঘটিবে। আমি সেই লক্ষণ দেখিতে পাইতেছি।
শত্রু সম্পত্তি ঘোষণার কথা আমিও শুনিয়াছি। তবে এখনও তাহা কার্যকরী হয় নাই। আমি অন্তত তেমন কিছু জানি না।
ভাষা লইয়া যে আন্দোলন শুরু হইয়াছে তাহাতে এই তমসাচ্ছন্ন সময়ে আলোর রেখা দেখা যাইতেছে। আমি তাই আরও কিছুকাল অপেক্ষা করিতে চাই।
যে লোকটি তোমার পত্র লইয়া আসিয়াছে তাহার নাম জয়নাল। সে পাকিস্তানি, ফরিদপুরে বাড়ি। তোমার চিঠি কিভাবে পাইল, জিজ্ঞাসা করায় জানাইল, নিত্য দাস তাহাকে দিয়াছে। নিত্য নাকি জয়নালের মতো আরও বহু পাকিস্তানি মারফত সম্পত্তি বিনিময়ের কারবার করিতেছে। লোকটা যে অত্যন্ত ধুরন্ধর তাহা অনেক দিন ধরিয়াই জানি। অবশ্য একটা বিশেষ উপকার সে করিয়াছে। তোমার পত্র কৌশলে আমার নিকট পৌঁছাইয়া দিয়া দুর্ভাবনার অবসান ঘটাইয়াছে।
জয়নালকে আমি কিছু টাকা দিয়াছি। সে বলিয়াছে, তুমি চিঠি লিখিলে সে নিত্য দাসের নিকট হইতে লইয়া আসিবে। আপাতত উহাদের মাধ্যমে তোমার সহিত যোগাযোগ রাখিতে হইবে।
তোমার দুই দিদা এবং আমি ভাল আছি। সুধাদের কাছে ঝিনুক আনন্দে আছে, তাহার অপ্রকৃতিস্থ ভাবটা কাটিয়া গিয়াছে, ইহাতে নিশ্চিন্ত বোধ করিলাম।
তোমাদের সকলের কুশল কামনা করি। আমাদের আশীর্বাদ এবং স্নেহ লইও। তোমার পত্রের আশায় রহিলাম।
ইতি
আশীর্বাদক দাদু
চিঠিটা এক নিশ্বাসে পড়ে মুখ তুলল বিনু। সবাই ধীর আগ্রহে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
নিত্য দাস বলল, জয়নাল আমারে খবর পাঠাইছে, হ্যামকত্তা বাড়ি জমিন অহন এচ্চেঞ্জ করতে চান না। চিঠিতে কি হেই কথাই লেখছেন ছুটোবাবু?
বিনু আস্তে মাথা নাড়ে, যা।
আপনে তেনারে বুঝাইয়া আবার চিঠি দ্যান। লেখবেন, পাকিস্থানে হিন্দুরা থাকতে পারব না। দ্যাশের মায়ায় হেইখানে পইড়া থাইকা তেনি য্যান নিজের সব্বনাশ ডাইকা না আনেন। শাজাহান সাহেবরে কমু আর কয়দিন অপেক্ষা করেন। হুড়পার কইরা অন্যের জমিন জুমিনের লগে এঞ্জে (এক্সচেঞ্জ) কইরা য্যান না ফেলান।
বিনু দ্রুত ভেবে নিল, হেমনাথকে তার খোয়ানো সার্টিফিকেট আর ডিগ্রির জন্য চিঠি তো লিখতেই হবে। তা ছাড়া, সম্পত্তি বিনিময়ের ব্যাপারে যাতে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেন সেটার ওপর বিশেষ ভাবে জোর দেবে। হেমনাথ বড় বেশি আবেগপ্রবণ। বাঙালি জাতীয়তাবাদ নিয়ে তিনি যা ভাবছেন সেটা হয়তো অলীক স্বপ্নমাত্র। বাংলা ভাষার ব্যাপারে পূর্ব বাংলা যে খুবই ক্ষুব্ধ, পাকিস্তানের কাগজগুলোতেও তার কিছু কিছু রিপোর্ট বেরিয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হল করাচি। অবাঙালি মুসলমানদের হাতেই সর্বস্ব। অর্থ, রাজনৈতিক শক্তি, সেনাবাহিনী। বাঙালি মুসলমানেরা সংখ্যায় বেশি হতে পারে কিন্তু অবাঙালিদের বিরুদ্ধে কতটা কী করতে পারবে, তাদের ক্ষোভ আদৌ বিস্ফোরণে ফেটে পড়বে কিনা, সে সম্বন্ধে যথেষ্ট সংশয় আছে। এই তো সেদিন দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগ হল। এর মধ্যেই পূর্বপাকিস্তানে হিন্দু-মুসলমান মিলিতভাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের নব জাগরণ ঘটাবে, এতখানি আশাবাদী বিনু অন্তত নয়। সে হেমনাথকে লিখবে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তিনি যেন কলকাতায় চলে আসার ব্যবস্থা করেন। অবশ্যই সম্পত্তি বিনিময় করে।
নিত্য দাস বলল, আমার অন্যখানে এট্টা জরুরি কাম আছে ছুটোবাবু। অহনই উঠতে হইব। আপনে ভালা কইরা গুছাইয়া চিঠি লেইখা রাইখেন। দুই এক দিনের মইদ্যে আইসা আমি লইয়া যামু।
নিত্য চলে যাবার পর ঝিনুকরা ছুটে বাইরের ঘরে চলে আসে। তিনজনেরই এক প্রশ্ন, হেমনাথ কী লিখেছেন?
চিঠিটা তাদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বিনু বলল, পড়ে দেখ—
একে একে সবাই পড়ে ফেলল। প্রথমে ঝিনুক। তারপর সুধা। শেষে হিরণ।