আজই চাকরিটা হয়ে যাবে, কল্পনাও করে নি বিনু। মনে মনে ডানা মেলে মহাকাশে উড়তে ইচ্ছা হচ্ছিল তার। বলল, না না, কোনও অসুবিধে নেই।
জগদীশ বললেন, গুড। তবে একটা কথা প্রথমেই বলে রাখি—
জিজ্ঞাসু চোখে বিনু তাকায়।
জগদীশ বলেন, আমাদের নতুন কাগজ। এখনও পাবলিকেশন শুরু হয় নি। খুব বেশি কিছু এক্সপেক্ট করো না। আপাতত ট্র্যাভেল এক্সপেন্স মিলিয়ে দেড়শ’র মতো পাবে।
বিনু চুপ করে থাকে।
আনন্দ তার হয়েই জবাবটা দেয়, ঠিক আছে। আসছে মাস থেকে ও কাজ শুরু করে দেবে।
জগদীশ বললেন, নিউজপেপারের প্রসপেক্ট যথেষ্ট ভাল। স্বাধীনতার পর থেকে লোকে নানা খবর জানতে চায়। রিডারশিপ বাড়ছে। আমাদের কাগজ দাঁড়িয়ে গেলে এমপ্লয়ীরা বঞ্চিত হবে না।
.
৩.৩৯
নিত্য দাস কথা রেখেছে। ঠিক তের দিনের মাথায় হেমনাথের চিঠি নিয়ে হাজির হল। লোকটা যে করিঙ্কৰ্মা, তাতে আর বিন্দুমাত্র সংশয় নেই।
যথারীতি সুধাদের দোতলার ড্রইং রুমে নিত্যকে বসানো হয়েছে। তার মুখোমুখি বসেছে হিরণ, বিনু এবং সুধাও। হেমনাথ বিনুর চিঠির কী উত্তর দিয়েছেন তা জানতে বিনুদের মতো সুধাও ভীষণ উগ্রীব। ঝিনুক অবশ্য আসে নি। সে ভেতর দিকের একটা ঘরে রয়েছে। নিত্যকে সে পছন্দ করে না। তবে তার সমস্ত ইন্দ্রিয় টান টান। বাইরের ঘরে কী কথা হয়, শোনার জন্য তার শ্বাসপ্রশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে গেছে।
পকেট থেকে মুখবন্ধ একটা মোটা খাম বার করে বিনুর হাতে দিতে দিতে নিত্য দাস বলল, এই ন্যান (নিন) হ্যামকুত্তার জবাব–
খামটা নিয়ে বিনু জিজ্ঞেস করল, কী লিখেছে দাদু?
নিত্য দাস হাসল, হেয়া (তা) আমি ক্যামনে জানুম? জবাবখান তো খামের ভিতরে। পইড়া দ্যাখেন–
বিনু বুঝল, প্রশ্নটা আহাম্মকের মতো হয়ে গেছে। খামের মুখ ছিঁড়ে চিঠি বার করল সে। হেমনাথের হাতের লেখা একটু টানা হলেও খুবই পরিচ্ছন্ন। কাটাকুটি নেই। সাধু বাংলায় তিনি চিঠিপত্র লেখেন।
বিনু পড়তে লাগল :
কল্যাণীয় বিনু,
তোমরা রাজদিয়া হইতে চলিয়া যাইবার পর কী উৎকণ্ঠার ভিতর আমাদের দিন কাটিয়াছে, বুঝাইয়া বলিতে পারিব না। রাজেকের মুখে শুনিয়াছি, মহা বিপদের মধ্যে তোমরা তারপাশার স্টিমারঘাটায় পৌঁছাইয়াছিলে। যে কোনও মুহূর্তে মৃত্যু ঘটিতে পারিত। তারপাশায় যাইবার পর কী হইয়াছে, জানিতে পারি নাই।
যাহা হউক, তোমরা শেষ পর্যন্ত শত বিপত্তির মধ্যেও যে কলিকাতায় যাইতে পারিয়াছ, ইহা ঈশ্বরের অশেষ করুণা।
লিখিয়াছ, বর্তমানে সুধা এবং হিরণের বাড়িতে নিরাপদে আছ। অবনীমোহন তীর্থধর্ম সারিয়া কলিকাতায় ফিরিলে তাহার নিকট চলিয়া যাইবে। সুনীতিদের সম্পর্কে কিছু জানাও নাই। উহাদের সঙ্গে কি তোমার দেখাসাক্ষাৎ হয় নাই?
বর্তমানে রাজদিয়া সম্পর্কে তোমাকে কিছু সংবাদ দিতেছি। এখানকার অবস্থা আগের তুলনায় অনেক বেশি উত্তেজনাপূর্ণ। চারিদিকের গ্রামগঞ্জে হঠাৎ রাজাকারদের উৎপাত বাড়িয়া গিয়াছে। তবে রাজদিয়ায় এখনও তাহারা হানা দেয় নাই। তোমরা চলিয়া যাইবার পর কিছু বিহারী মুসলমান ইণ্ডিয়া হইতে আসিয়া এখানে প্রচণ্ড উৎপাত করিতেছে। আমাকে না হইলেও অন্যদের প্রকাশ্যেই শাসাইতেছে। উদ্দেশ্য, হিন্দুরা চলিয়া গেলে তাহাদের জমিজমা বাড়িঘর দখল করিয়া বসা।
মানুষের মনোবল প্রায় ধসিয়া পড়িয়াছে। প্রতিদিন দলে দলে তাহারা দেশ ছাড়িয়া চলিয়া যাইতেছে। এই ভাঙন রোধ করিবার উপায় নাই।
সাধারণ অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, নিরীহ মানুষজনকে দোষ দিয়া কী হইবে? গান্ধীজি একবার স্থির করিয়াছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানে আসিয়া থাকিবেন। হয়তো আসিতেন, কিন্তু তাহার পূর্বেই নিহত হইলেন। তিনি আসিলে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি হয়তো বদলাইয়া যাইত।
তোমার খুব সম্ভব মনে নাই, সাতচল্লিশের অক্টোবরে এক প্রার্থনাসভায় গান্ধীজি পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের উপদেশ দিয়াছিলেন, তাহারা যেন দেশত্যাগ না করে। ঈশ্বর ছাড়া অন্য কাহাকেও ভয় পাওয়ার কারণ নাই। যাহারা প্রকৃত সাহসী শাসানির ভয়ে তাহারা কেহ পিতৃপুরুষের ঘরবাড়ি ছাড়িয়া আসে না। আত্মসম্মান নষ্ট হওয়ার চেয়ে মৃত্যুও শ্রেয়।
পরবর্তী কালে বহু ভারতীয় নেতার মুখেও প্রায় একই উপদেশ শোনা গিয়াছে। দূর হইতে উপদেশবর্ষণ করা অনেক সহজ। তাঁহাদের নিকট আমার বিশেষ আর্জি, ছদ্মবেশে, প্রহরীহীন অবস্থায় একবার আসিয়া পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা স্বচক্ষে দেখিয়া যান।
তুমি তো জানো, দেশভাগের সঙ্গে সঙ্গে এই বঙ্গের শিক্ষিত সম্প্রদায় বলিতে যাহাদের বুঝি উকিল, অধ্যাপক, স্কুলশিক্ষক, সরকারি বেসরকারি কর্মকর্তা, এমনকি রাজনৈতিক দলের নেতা তাহাদের শতকরা নব্বই ভাগ ইণ্ডিয়ায় পলায়ন করিয়াছে। সাধারণ মানুষ কাহার ভরসায়, কাহার মুখের দিকে তাকাইয়া থাকিবে? পুলিশের নিকট অভিযোগ জানাইতে গেলে লাঞ্ছিত হইতে হয়। প্রশাসন সংখ্যালঘুদের সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন। ভারত সরকার পাকিস্তানের উপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি না করিলে দেশত্যাগ বন্ধ হইবে না।
তুমি সম্পত্তি বিনিময়ের যে কথা লিখিয়াছ তাহা যথেষ্ট উৎসাহজনক। শাজাহান সাহেবের জমিজমা এবং বাড়ির মূল্য আমাদের বিষয় আশয়ের সমান সমানই হইবে। সেদিক হইতে কোনও লোকসান নাই। তবু এই মুহূর্তে আমি সিদ্ধান্ত লইতে পারিতেছি না। তাহার কারণও জানাইতেছি।