জগদীশ বললেন, এস আনন্দ। বসো
পুরো চেম্বারটার মেঝে জুট কার্পেট দিয়ে মোড়া। এক পাশের দেওয়াল ঘেঁষে ঝকঝকে নতুন দু’টো আলমারি।
জগদীশের টেবলে তিনটে টেলিফোন। সাত আটটা পেন। অজস্র ফাইল। এধারে দর্শনপ্রার্থীদের জন্য গদিমোড়া, আরামদায়ক আট দশটা চেয়ার।
জগদীশ চেয়ারগুলোর দিকে আঙুল বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। আনন্দরা বসে পড়ল।
অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছিল বিনুর। সেটা কি ভয়? নার্ভাসনেস? মৃদু উত্তেজনা? না কি সব কিছুর মিশ্রণ? আনন্দ যদিও শতকরা একশ ভাগ আশ্বাস দিয়েছে, তবু সে জানে, টেবলের উলটো প্রান্তে বসে-থাকা রাশভারী মানুষটির ইচ্ছা বা মর্জির ওপর তার চাকরি নির্ভর করছে।
বিনুকে দেখিয়ে জগদীশ আনন্দকে জিজ্ঞেস করলেন, এর কথাই তো বলেছিলে?
হ্যাঁ। আনন্দ মাথা হেলায়।
জগদীশ ধীর, স্থির, তীক্ষ্ণবুদ্ধি মানুষ। কোনও রকম তাড়াহুড়ো নেই। ছোট ছোট ক’টি প্রশ্ন করে বিনুর শিক্ষাগত যোগ্যতা, পাকিস্তান থেকে সে কবে এসেছে, সেখানকার পরিস্থিতি কতটা আতঙ্কজনক কলকাতায় আসার সময় বিপদে পড়তে হয়েছিল কিনা, ইত্যাদি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে নিলেন।
ঝিনুকের প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে বাকিটা ঠিক ঠিক বলে গেল বিনু। এমনকি জগদীশ জানতে না চাইলেও তার সার্টিফিকেট এবং ডিগ্রি কিভাবে খোয়া গেছে তাও শোনাল।
ডিগ্রি টিগ্রিগুলোর ব্যাপারে আপাতত খুব একটা গুরুত্ব দিলেন না জগদীশ। ওগুলো পরে আনিয়ে দিলেও চলবে। কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, আনন্দকে কথা দিয়েছি, আমার কাগজে তোমাকে নিশ্চয়ই নেব। কাগজে অনেক ডিপার্টমেন্ট থাকে। সার্কুলেশন, অ্যাকাউন্টস, রিপোর্টিং, প্রুফ রিডিং, সাব এডিটিং–এমনি কত কী। কোথায় কাজ করতে চাও?
বিনুর সারা শরীরে শিহরন খেলে গেল। এখন সে নিশ্চিত, এখানে চাকরি তার হচ্ছেই। আনন্দ অলীক আশ্বাস দেয় নি। কাঁপা গলায় বলল, আমি আগে কোথাও কাজ করি নি। চাকরির কোনও অভিজ্ঞতা নেই। আপনি যেখানে বলবেন–
জগদীশ বিনুর সঙ্গে কথা বলে মনস্থির করে ফেলেছিলেন। বললেন, ইয়াং ম্যান, তোমাকে এমন একটা কাজ দিতে চাই, যার মধ্যে চ্যালেঞ্জ আছে। বলেই বেল বাজালেন।
শশব্যস্ত সেই বেয়ারাটা দৌড়ে চেম্বারে চলে আসে। জগদীশ বললেন, তারাপদবাবুকে আমার চেম্বারে আসতে বল। এখুনি যেন চলে আসেন।
কিছুক্ষণ পর মাঝবয়সী তারাপদ এলেন। পাতলা চুল, গোল মুখ। শ্যামবর্ণ। একহারা মেদহীন চেহারা। পুরু লেন্সের আড়ালে ঝকঝকে, বুদ্ধিদীপ্ত চোখ। পরনে ধবধবে ধুতি পাঞ্জাবি। পায়ে মোটা সোলের চপ্পল।
জগদীশ বিনুর সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিলেন, এ হল বিনু, মানে বিনয়। আর উনি তারাপদ ভৌমিক, আমাদের কাগজের নিউজ এডিটর। তারাপদকে বললেন, এই ছেলেটি দিন কয়েক আগে পাকিস্তান থেকে এসেছে। ওকে আমাদের কাগজে নিচ্ছি। বিনয় পাকিস্তানে যা চলছে তার ভিভিড ডেসক্রিপশন দিচ্ছিল। রিফিউজি প্রবলেম তো এখন ইণ্ডিয়ার একটা জ্বলন্ত সমস্যা। কবে যে তা মিটবে, কেউ জানে না। অন্য সব কাগজে রিফিউজিদের নিয়ে লেখালিখি নিশ্চয়ই হচ্ছে। কিন্তু আমরা এই বিষয়টার ওপর বিশেষভাবে জোর দিতে চাই। একটু থেমে বললেন, বিনয় যা বলল সেটা কাগজে বেরুলে সেনসেশন হবে। তবে ও কিরকম লিখতে পারবে, জানি না। আপনার সঙ্গে ওকে নিয়ে যান। একটা ছোট কিছু লিখতে দিয়ে দেখুন, কতটা কী পারে। আধ ঘণ্টা পর ওকে নিয়ে আমার কাছে আসবেন।
তারাপদ ভৌমিকের কামরাটা হল-ঘরের অন্য প্রান্তে। মানুষটি সহৃদয়, স্নেহপ্রবণ। নতুন করে পাকিস্তানে তার নানা অভিজ্ঞতার কথা তাঁকে বলতে হল। গভীর মনোযোগে সব শুনে তিনি বিনুকে রামরতন গাঙ্গুলির শোচনীয় মৃত্যুর ঘটনাটা লিখতে বললেন।
বিনুর চোখের সামনে দৃশ্যটা ভাসছে। কুড়ি বাইশ মিনিটের ভেতর সেটা লিখে ফেলল সে।
মাত্র আড়াইটা পাতা। এক নিশ্বাসে পড়ে ফেললেন তারাপদ। দু’চারটে সংস্কৃত-ঘেঁষা খটমট শব্দ বাদ দিলে লেখার স্টাইলটা ভাল। নির্ভুল, ঝরঝরে বাংলা।
তারাপদ খুঁত শুধরে দিয়ে বললেন, খবরের কাগজ কলেজ ইউনিভার্সিটির পণ্ডিত মাস্টারমশাইরাই শুধু পড়ে না। নাইন্টি পারসেন্ট হল সাধারণ আধা-শিক্ষিত পাঠক। শক্ত শক্ত শব্দ লিখলে তারা বুঝতে পারবে না। ভাষাটা সহজ না হলে তাদের সঙ্গে কমিউনিকেট করা যাবে না। কথাটা মনে থাকবে?
থাকবে। ঘাড় হেলিয়ে দেয় বিনু। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে, লেখাটা ঠিক হয়েছে?
উত্তর না দিয়ে তারাপদ বললেন, চল আমার সঙ্গে। বিনুকে সঙ্গে করে জগদীশের চেম্বারে আবার এলেন তিনি।
জগদীশ উৎসুক চোখে তাকালেন।
তারাপদ বললেন, ল্যাংগুয়েজের ওপর দখল আছে। লেখার স্টাইল ভাল। ছোট একটা পিস লিখতে দিয়েছিলাম। রিয়ালি গুড। মনেই হয় না আনকোরা, ইন-এক্সপিরিয়েন্সড একটা ছেলে লিখেছে।
একজন পাকা বার্তা-সম্পাদক এমন ঢালাও প্রশংসা করবেন, ভাবতে পারে নি বিনু। ভেতরে ভেতরে প্রবল উদ্দীপনা বোধ করছিল সে। সেই সঙ্গে বিহ্বলও হয়ে পড়েছিল।
জগদীশ জিজ্ঞেস করলেন, কী হিসেবে ওকে নিলে ভাল হয়? সাব-এডিটর, না রিপোটার?
তারাপদ বললেন, আমার তো মনে হয়, রিপোর্টিংয়ে দিলে যথেষ্ট ভাল করবে।
ঠিক আছে। আপনাকে আর আটকে রাখব না।
তারাপদ চলে গেলেন।
জগদীশের আগের সেই গাম্ভীর্য এখন অনেকখানি উধাও। তারাপদর সুপারিশ তাকে খুশি করেছে। হাসিমুখে বিনুকে বললেন, এ মাস তো শেষ হয়ে এল। আমার ইচ্ছা, নেক্সট মান্থের এক তারিখ থেকে জয়েন কর। অসুবিধে নেই তো?।