মিনিট পাঁচেকও বসতে হল না। আনন্দ এসে হাজির। মেয়েটা তা হলে আনন্দকেই ফোনে তার আসার খবরটা দিচ্ছিল।
সোফার কোণে সিটিয়ে বসে ছিল বিনু। এক পলক তাকে দেখল আনন্দ। পরক্ষণে তার চোখ চলে গেল রিসেপশনিস্ট মেয়েটির দিকে। বিনুর আড়ষ্টতার কারণটা আঁচ করে নিল সে। বলল, চল, বেরুনো যাক।
আনন্দকে দেখে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে বিনু। বলল, আপনার ছুটি পাঁচটায়। এখন সবে চারটে পাঁচ। এক্ষুনি বেরুবেন?
নো প্রবলেম। আমার ডিপার্টমেন্টের আমিই টপ ম্যান। কখন বেরুব না-বেরুব, সে জন্যে কাউকে কৈফিয়ৎ দিতে হবে না। তা ছাড়া, জগদীশবাবুর সঙ্গে আজ সকালে আমার কথা হয়েছে। তোমাকে সোয়া পাঁচটা নাগাদ নিয়ে যেতে বলেছেন। সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউতে যেতেও তো খানিকটা সময় লাগবে।
বিনু কিছু বলল না।
অফিসের বাইরে এসে আনন্দর একটু মজা করতে ইচ্ছা হল, লিজার সামনে অমন কাঠ হয়ে বসে ছিলে কেন?
জানা গেল রিসেপশনিস্ট মেয়েটির নাম লিজা। মুখ লাল হয়ে ওঠে বিনুর। বলে, না, মানে–
কলকাতায় এসেছ। এরকম কত মেয়ের সঙ্গে আলাপ হবে। ট্রাই টু বি স্মার্ট। গা থেকে রাজদিয়ার গন্ধটা যত তাড়াতাড়ি পার, ঝেড়ে ফেল। নইলে এখানে টিকতে পারবে না।
আচ্ছা আনন্দদা—
বল—
আপনাদের অফিসে বুঝি সোজাসুজি ভেতরে যাওয়া যায় না?
আনন্দ আন্দাজ করে নিল, বিনুর মাথায় লিজা এখনও ভর করে আছে। বলল, ব্রিটিশ কোম্পানির অফিস তো। তাদের কিছু কায়দাকানুন আছে। রিসেপশানিস্টের গ্লু দিয়েই ভেতরে যেতে হয়। আচ্ছা–
বিনু উৎসুক দৃষ্টিতে তাকায়।
আনন্দর চোখ থেকে কৌতুক উপচে পড়ছিল। বিনুকে আরেকটু খোঁচাতে চাইছিল সে। বলল, লিজার সামনে কয়েক মিনিট তো বসে ছিলে। রিয়ালি বিউটিফুল, সাঙ্ঘাতিক ফিগার। কি, ঠিক বলছি?
আরেক বার মুখটা আরক্ত হল বিনুর। তবে সে লিজার ধার কাছ দিয়েও গেল না। বলল, ইণ্ডিয়া তো স্বাধীন হয়ে গেছে। এখনও এদেশে ব্রিটিশ কোম্পানি আছে?
প্রচুর। তবে বেশিদিন থাকবে না। পাঁচ সাত বছরের ভেতর ইণ্ডিয়ানদের হাতে কারবার টারবার বেচে দিয়ে দেশে ফিরে যাবে।
ফুটপাত ধরে ওরা খানিকটা এগিয়ে এসেছিল।
আনন্দ এবার জিজ্ঞেস করল, কিভাবে যাবে বল?
বুঝতে না পেরে বিনু বলল, কিভাবে বলতে?
ট্যাক্সি নিলে মিনিট পনের কুড়ির ভেতর পৌঁছে যাব। তবে ওখানে গিয়ে জগদীশবাবুর জন্যে ওয়েট করতে হবে। আমার ইচ্ছে হেঁটেই যাই। তা হলে এই অফিস পাড়াটা মোটামুটি তোমাকে চিনিয়ে দিতে পারব। তাই একটু আগে আগে অফিস থেকে বেরুলাম।
সোয়া পাঁচটার মধ্যে পৌঁছতে পারব তো?
নিশ্চয়ই। ওখানে যাওয়াটাই তো আসল ব্যাপার।
বিনু বলল, হেঁটেই চলুন। কলকাতাটা ভাল করে চেনা দরকার।
রাইটার্স বিল্ডিং, স্টক এক্সচেঞ্জ, ব্র্যাবোর্ন রোড, বৌবাজার স্ট্রিট, চিৎপুর রোড, নাখোদা মসজিদ, ইত্যাদি দেখাতে দেখাতে ওরা হ্যাঁরিসন রোডের ক্রসিংয়ে চলে এল। সেখান থেকে ডান দিকে ঘুরে সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউ।
জগদীশ গুহঠাকুরতাদের কাগজের অফিসটা বিবেকানন্দ রোডের কাছাকাছি। বিনুরা যখন সেখানে এল, পাঁচটা বেজে দশ। পাঁচ মিনিট আগেই তারা পৌঁছে গেছে।
.
তেতলা বাড়িটা পুরনো হলেও বেশ মজবুত। ভিত এত শক্তপোক্ত যে অনায়াসে আরও তিরিশ চল্লিশ বছর টিকে যাবে। দেখতে আহামরি কিছু নয়। খুবই সাদামাঠা। কারুকার্যহীন।
ভেতরে ঢুকতেই বিনুর চোখে পড়ল, বিশাল একটা হল-ঘর। সেটার একদিকে ছাপাখানা। বেশ কিছু লোজন সেখানে রয়েছে। একটা লম্বা ধরনের মস্ত যন্ত্রে ঝড় তুলে কী যেন ছাপা হচ্ছে। আনন্দ বলল, ওটা রোটারি মেশিন। জগদীশবাবুরা যে কাগজ বার করবেন, সেটা এই মেশিনেই ছাপা হবে। এখন তার ট্রায়াল চলছে।
হল-ঘরের আরেক দিকে তিনটে লাইনো মেশিনের সামনে বসে তিনটে লোক বোম টিপে টিপে কম্পোজ করে চলেছে। মেশিনগুলো বিনুকে চিনিয়ে দিল আনন্দ। এ দিকেই এক কোণে বিরাট বিরাট গোলাকার চাকার মতো বিদেশি নিউজপ্রিন্টের রিল উঁই হয়ে পড়ে আছে।
হল-ঘরের শেষ প্রান্তে চওড়া চওড়া সিঁড়ি। আনন্দরা দোতলায় এল। এখানেও মস্ত হল-ঘরে কাঠ আর কাঁচ দিয়ে তৈরি ছোট বড় অনেকগুলো ছোট বড় খুপরি। সেগুলোর ভেতর কিছু লোজন দেখা গেল।
আনন্দ বিনুকে সঙ্গে করে এবার সোজা তেতলায় উঠে এল। নিচের ফ্লোর দুটোর মতো এখানেও একই মাপের হল-ঘর। সেটার আধাআধি জুড়ে প্রচুর চেয়ার টেবল পাতা রয়েছে। বাকি অর্ধেকটায় কাঁচ দিয়ে ঘেরা অনেকগুলো চেম্বার। কয়েকটা চেম্বারে কিছু লোকজন দেখা গেল। বাকিগুলো ফাঁকা।
একটা টেলিপ্রিন্টার মেশিন অবিরল খটখট আওয়াজ তুলে হিল্লিদিল্লির খবর নিয়ে আসছে। ওটার মুখ থেকে লম্বা কাগজে সেই সব সংবাদ বেরুচ্ছে একটানা। ছেদহীন।
টেলিপ্রিন্টারের কার্যকারিতা বুঝিয়ে দিয়ে হল-ঘরের শেষ প্রান্তে সবচেয়ে বড় চেম্বারটার সামনে চলে এল আনন্দরা।
চেম্বারের দরজার সামনে উঁচু টুলে বসে ছিল একটি অল্প বয়সের বেয়ারা। ত্বরিত পায়ে উঠে দাঁড়িয়ে সে বলল, সাহেব আপনাদের জন্যে অপেক্ষা করছেন–
বিনু আন্দাজ করে নিল, এখানে আনন্দর যাতায়াত আছে। বেয়ারাটা তাকে চেনে।
চেম্বারের ভেতরে যেতেই বিনু দেখতে পেল, বিশাল সেক্রেটারিয়েট টেবলের ওধারে রিভলভিং চেয়ারে যিনি বসে আছেন তার বয়স পঁয়ষট্টি ছেষট্টি। মাঝারি হাইট। টকটকে ফর্সা রং। লম্বা ধাঁচের মুখ। শরীরে কিছু মেদ জমেছে, এই বয়সে যেমনটা হয়। চওড়া কপাল। এই বয়সেও প্রচুর চুল। তবে বেশির ভাগই সাদা। চোখে পুরু ফ্রেমের চশমা। পরনে ঢোলা ট্রাউজার্স, শার্ট এবং কোট। তাঁর সমস্ত চেহারায় শান্ত গাম্ভীর্য। তিনিই যে জগদীশ গুহঠাকুরতা, না বলে দিলেও চলে।