কিছুক্ষণের মধ্যে হিরণ অফিস থেকে ফিরে এল। আজ্ঞা নতুন করে জমে ওঠে। ফের চা আসে, ফের খাবার।
রাত একটু বাড়লে ঝুমা বলল, মামা, এবার বাড়ি ফিরতে হবে। কাল সাড়ে দশটা থেকে আমার ক্লাস–
আনন্দ ব্যস্ত হয়ে পড়ে, হ্যাঁ হ্যাঁ, এখুনি বেরুব। হিরণ এবং সুধাকে বলল, বিনুর একটা চাকরির ব্যাপারে কথা বলতে এসেছিলাম। ওকে সব জানিয়েছি। তোমরাও শোন।
সবিস্তার সব বলল আনন্দ। খুঁটিনাটি কিছুই বাদ দিল না। তারপর জিজ্ঞেস করল, বিনু রাজি আছে। তোমরা কী বল?
সুধা বলল, খবরের কাগজের চাকরি। বিনু তো এ ধরনের কাজ আগে করে নি। পারবে কি?
আনন্দ বলল, বিনুও সেই কথাই বলছিল। এত লোক পারছে, ও-ই বা পারবে না কেন? কাজ। করতে করতে শিখে নেবে। একটু ভেবে বলল, জার্নালিস্টই যে হতে হবে, তার কোনও মানে নেই। নিউজ পেপারে কত ডিপার্টমেন্ট আছে। যেখানে সুটেবল মনে হবে সেখানেই জগদীশবাবু ওঁকে প্লেস করে দেবেন।
সুধা বলল, গভর্নমেন্ট সারভিস হলে ভাল হত।
আনন্দ বলল, শুনলাম হিরণ ওদের ডিপার্টমেন্টে চেষ্টা করছে। সেটা–
তাকে থামিয়ে দিয়ে হিরণ বলল, সরকারি চাকরি তো বললেই হয়ে যায় না। যদ্দিন না হচ্ছে, বসে থাকবে কেন? যেটা হাতে এসেছে, নিয়ে নেওয়াই ভাল।
সুধা আর আপত্তি করে না।
আনন্দ উঠে পড়তে পড়তে বলে, বিনু, কাল ঠিক সময়ে আমার অফিসে চলে যেও।
বিনু মাথা নাড়ে, আচ্ছা—
.
রাতে খাওয়াদাওয়ার পর বিনুকে একা পেয়ে চাপা গলায় ঝিনুক বলে, ঝুমা এসেছিল কেন?
বিনু বলল, এতক্ষণ ছিল। ওকে জিজ্ঞেস করলেই পারতে।
তোমাকে করছি। তুমি উত্তর দাও।
ওর মামা ওকে নিয়ে এসেছে, তাই এসেছে। এখানে আমার কিছু করার নেই।
কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকে ঝিনুক। নিষ্পলকে। তারপর বলে, বাড়িতে কেউ নেই, দু’জনে খুব মজা করলে, তাই না?
বুকের ভেতরটা ধক করে ওঠে বিনুর। ঝিনুকের কথায় কোন সংকেত রয়েছে, নিমেষে টের পেয়ে যায় সে। এর মধ্যেই বুঝে গেছে, এই মেয়েটিকে সুস্থ স্বাভাবিক রাখতে অনেকখানি কৌশল। প্রয়োজন। দরকার কিছুটা কপটতার। গম্ভীর মুখ করে বিনু বলে, বাড়িতে উমা আর আনন্দদা ছিল। মজা করবার সময় পাওয়া যায় নি। চাকরির খবর নিয়ে আনন্দদা এসেছিল। তার সঙ্গে কথা বলতে বলতে তোমরা এসে গেলে।
সারাক্ষণ চাকরির কথাই বলছিলে? ঝিনুক বলতে লাগল, একবারও আলাদা করে ঝুমা তোমার সঙ্গে গল্প করে নি?
সুনীতিদের বাড়িতে প্রায় এমনটাই ঘটেছিল। ঝিনুক তখন একতলায়। দোতলায় ছিল বিনু সুনীতি মাধুরী আর ঝুমা। ঝিনুক ধরেই নিয়েছিল, ঝুমা সুযোগ করে নিয়ে তাকে কাছে পেতে চেষ্টা করেছে। ঝুমা সম্পর্কে সন্দেহটা কোনও দিনই বুঝিবা ঘুচবে না ঝিনুকের।
বিনু বলল, আনন্দদাকে তো এখন পাচ্ছ না। উমা আছে। তাকেই জিজ্ঞেস করে দেখ। বলেই এস্ত হয়ে ওঠে। ঝোঁকের মাথায় বিরাট ঝুঁকি নেওয়া হল। পরক্ষণে ভাবে, কাজের মেয়ের কাছে এমন একটা ব্যাপারে কি খোঁজ নিতে যাবে ঝিনুক? কিন্তু সন্দেহের কীট যার মাথায় অবিরত বিষ ঢালছে তার পক্ষে কোনও কিছুই কি অসম্ভব?
আপাতত কটা দিন সহজভাবে শ্বাস নিতে পারবে না বিনু।
.
৩.৩৮
ডালহৌসি স্কোয়ারে আনন্দদের অফিস। সেখানে কিভাবে, কোন রুটের ট্রাম বা বাস ধরে যেতে হবে, জলের মতো বুঝিয়ে দিয়েছিল সে।
সুধাদের বাড়ি থেকে তিনটে নাগাদ বেরিয়ে ট্রামই ধরল বিনু। চল্লিশ মিনিটের ভেতর ডালহৌসি পৌঁছে গেল। যেদিকেই তাকানো যাক, একটা প্রকাণ্ড দীঘি ঘিরে বিশাল বিশাল সব বিল্ডিং।
আনন্দদের অফিসটা ক্লাইভ স্ট্রিটে। মস্ত ঘড়িওলা জি.পি.ও’র পাশ দিয়ে উত্তর দিকে মিনিট তিনেক হাঁটলেই বাঁ ধারের ফুটপাতে ক্রফোর্ড ম্যানসন। আনন্দ বলে দিয়েছিল, এই বাড়ির তেতলায় সে বসে।
রাস্তার লোককে জিজ্ঞেস করে করে ক্রফোর্ড ম্যানসন’-এ চলে এল বিনু। ব্রিটিশ আমলের বিরাট বাড়ি। গেটে উদি-পরা শিখ দারোয়ান। ছফিটের ওপর হাইট। মাথায় পাগড়ি। জবরদস্ত চেহারা। ভয়ে ভয়ে তার পাশ দিয়ে বিল্ডিংয়ে ঢুকলেই রিসেপশন। কাঁচের দেওয়াল দিয়ে ঘেরা সাজানো গোছানো, এয়ার কণ্ডিশনড চেম্বারে একটি ঝকঝকে অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান তরুণীকে দেখা গেল। তাকে এড়িয়ে ভেতরে যাবার উপায় নেই। কী করবে, বুঝে উঠতে পারছিল না বিনু। রাজদিয়ায় যার জীবনের বেশির ভাগটাই কেটে গেছে তার পক্ষে এই ধরনের অফিসের কায়দা কানুন জানার কথা নয়।
রিসেপশনিস্ট মেয়েটি বিনুকে দেখতে পেয়েছিল। হাতের ইশারায় চেম্বারে ডেকে বলল, ইয়েস, হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ?
সারা শরীরে অঢেল, উগ্র যৌবন। নখে ঠোঁটে গালে চড়া রং। বাদামি চুল কাধ পর্যন্ত ছাঁটা। পরনে টাইট স্কার্ট আর চাপা শার্ট। তার গা থেকে পারফিউমের ঝাঁঝাল গন্ধ উঠে আসছিল।
মেয়েটা সাত আট ফুট দূরে বসে আছে। বিনু আর তার মাঝখানে ওভাল শেপের গ্লাস-টপ টেবল, তিন চারটে টেলিফোন, পেন হোল্ডারে নানারকম কলম, টেবল ক্যালেণ্ডার, ভিজিটরস স্লিপের ক’টা প্যাড, ইত্যাদি।
এ ধরনের মেয়ের এত কাছাকাছি আসা তো দূরের কথা, আগে কখনও চোখে দেখে নি বিনু। হেমন্তের এই শীতল বেলাশেষে ঘামতে লাগল সে। নাকমুখ ঝা ঝাঁ করছে।
ঢোক গিলে পেঁয়ো উচ্চারণে, ইংরেজিতেই বিনু তার আসার উদ্দেশ্যটা জানিয়ে দিল।
রিসেপশনের একধারে অনেকগুলো সোফা আর সেন্টার টেবল রয়েছে। আছে ক’টা রঙিন ইংরেজি ম্যাগাজিন। মেয়েটি সোফাগুলো দেখিয়ে বলল, প্লিজ সিট দেয়ার একটা ফোন তুলে কার সঙ্গে যেন কথা বলে সেটা নামিয়ে রাখতে রাখতে বিনুর দিকে তাকাল, একটু অপেক্ষা করুন–