ঝুমা যা বলল তার এক বর্ণও মিথ্যে নয়। বিনু যেন চোখের সামনে দেখতে পেল, এই সমস্যাগুলো ক্রমশ বিশাল আকার নিয়ে বেড়াজালের মতো তাকে ঘিরে ফেলছে। জোরে জোরে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, জানি না, জানি না–
অনেকক্ষণ চুপচাপ।
হেমন্তের বিকেল ফুরিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। মিহি কুয়াশা নামছে, সেই সঙ্গে হিমও। চারদিক ঝাঁপসা হয়ে যাচ্ছে। মনে হয়, মহানগর যেন সারা গায়ে উলঙ্গবাহার শাড়ি জড়াতে শুরু করেছে।
অনেকক্ষণ চুপচাপ।
তারপর একেবারে অন্য কথায় চলে গেল ঝুমা। গাঢ় গলায় বলল, আমার একটা কথা রাখবে?
অন্যমনস্কর মতো বিনু জিজ্ঞেস করে, কী?
আমাদের বাড়ি তোমাকে যেতে হবে না।
তাদের বাড়িতে যাবার জন্য সেদিনও কত জোরাজুরি করেছে ঝুমা। কত অভিমান। হঠাৎ মতটা পালটে গেল কোন যাদুমন্ত্রে? বিমূঢ়ের মতো তাকিয়ে থাকে সে।
ঝুমা থামে নি, আমাদের বাড়ি গেলে সবাই ঝিনুকের কথা জিজ্ঞেস করবে। তোমার ভীষণ অস্বস্তি হবে। তার চেয়ে এক কাজ করো–
কী?
আমার কলেজের নামটা মনে আছে তো?
আছে। স্কটিশ চার্চ। কেন?
তুমি ওখানেই চলে যেও। আমার হিস্ট্রি অনার্স, ফার্স্ট ইয়ার। ভাল নাম শতরূপা। হিস্ট্রি ক্লাসে খোঁজ করলেই আমাকে পেয়ে যাবে।
ইঙ্গিতটা পরিষ্কার। গোপনে তার সঙ্গে দেখা করতে চাইছে ঝুমা। সেই পুরনো শিহরনটা নতুন করে বিনুর রক্তস্রোতে চমক দিয়ে যায়।
ঝুমা ব্যগ্র সুরে বলতেই থাকে, যাবে তো বিনুদা? আমি কিন্তু তোমার আশায় অপেক্ষা করে থাকব। কেউ কিছু জানতেও পারবে না।
হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন হঠাৎ সহস্র গুণ বেড়ে যায় বিনুর। ঝুমা যে সংকেতটা দিয়েছে তাতে মাথা ঝিম ঝিম করছে। তার শরীর থেকে সেই তীব্র সুঘ্রাণ, তার কথা বলার ভঙ্গি, তার তাকানো বিনুর স্নায়ুগুলোকে ফের বিবশ করে ফেলে।
বিনু কী বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ চোখে পড়ল, সামনের রাস্তা দিয়ে সুধা আর ঝিনুক আসছে। তাদের দু’জনের হাতেই মোটাসোটা সুদৃশ্য কাপড়ের ব্যাগ। বোঝা যায়, প্রচুর কেনাকাটা করেছে।
বিনু লহমায় ঘোরের ভেতর থেকে উঠে আসে। ভীষণ ব্যস্তভাবে বলে, চল চল, ওরা এসে গেছে– সে আর দাঁড়ায় না। স্তভাবে ব্যালকনি থেকে বাড়ির ভেতর দিকে চলে যায়। কুমার সঙ্গে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে ঝিনুক তুলকালাম বাধিয়ে দেবে।
ঝুমা কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকে। মুখটা ক্রমশ শক্ত হয়ে ওঠে। চোখে ক্ষণিকের জন্য ঝিলিক খেলে যায়। তারপর ধীরে ধীরে সেও ভেতরে চলে আসে।
.
উমা ঘরে ঘরে আলো জ্বালিয়ে দিয়েছিল। বিনু ব্যালকনি থেকে সোজা বাইরের ঘরে চলে আসে। সুধারা দুটো কাগজ রাখে। একটা বাংলা, একটা ইংরেজি। যুগান্তর’ এবং হিন্দুস্থান স্ট্যাণ্ডার্ড। সঙ্গী টঙ্গী নেই। অগত্যা একা একা বাইরের ঘরে বসে আনন্দ মর্নিং এডিশনের কাগজগুলো এই সন্ধেবেলাতেও উলটে পালটে দেখছিল। বিনুকে দেখে জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার, কোথায় ছিলে?
একটা সোফায় বসতে বসতে বিনু বলল, ওধারের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ঝুমার সঙ্গে কথা বলছিলাম।
ঝুমা এসে অন্য একটা সোফায় বসে। বলে, আমাদের কলেজের গল্প করছিলাম মামা। কোন প্রফেসর কিরকম পড়ান, কে দারুণ ফাঁকিবাজ, কোন স্টুডেন্ট ক্লাস পালিয়ে চৌরঙ্গিতে ইংলিশ পিকচার দেখতে যায়, কে মেয়েদের জ্বালাতন করে, এই সব।
বিনু হাঁ হয়ে যায়। কেউ যে বানিয়ে বানিয়ে এত মসৃণভাবে ডাহা মিথ্যে বলতে পারে, কে জানত! ঝুমার মুখ দেখে তা বোঝার উপায় নেই। মনে হয়, যুধিষ্ঠিরের পর এমন সত্যবাদী পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি জন্মায় নি।
আনন্দ এ নিয়ে আর কিছু জানতে চাইল না। নিচের দরজা খোলা ছিল। একটু পরেই সুধা আর ঝিনুক বাইরের ঘরে এসে ঢুকল। আনন্দদের দেখে সুধা খুব খুশি। বলল, ঝুমা, আনন্দদা, আপনারা কখন এসেছেন? হাতের ব্যাগ মেঝেতে নামিয়ে সে বসে পড়ল।
আনন্দ বলল, প্রায় ঘন্টা দেড়েক।
ইস। আসবেন, আগে জানান নি কেন? ঝিনুককে গিয়ে ভবানীপুরে গিয়েছিলাম। আজ না হয় না-ই যেতাম।
ভবানীপুরের খবরটা বিনুর কাছে পেয়েছি। হঠাৎ একটা দরকারে আসতে হল। জানাবার সময় পাই নি।
দরকারের কথা পরে হবে। চা খেয়েছেন?
শশব্যস্তে সুধা উঠতে যাচ্ছিল। বড় ভগ্নিপতি এবং তার ভাগনীকে আপ্যায়ন করাটা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিয়ে আনন্দ বলল, চা মিষ্টি, সব খাওয়া হয়েছে। তুমি ছিলে না। হোস্টের ভূমিকাটা সুন্দরভাবে পালন করেছে ঝুমা। উমাকে দিয়ে চা করিয়ে খাইয়েছে। হঠাৎ তার চোখে পড়ল ঝিনুক এখনও দাঁড়িয়ে আছে।
আনন্দ ঝিনুককে বলল, বসো–
একটু দূরে দু’টো মোড়া খালি পড়ে আছে। তার একটায় নিঃশব্দে বসল ঝিনুক।
বাইরের ঘরে ঢোকার পর থেকেই ঝিনুকের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে বিনু। পলকের জন্য নজর সরায় নি।
ঝিনুকের মুখে পর পর কত কিছুই যে ফুটে উঠছে। এই হয়তো ভয়, পরক্ষণে সংশয়, তারপরেই উত্তেজনা বা বিতৃষ্ণা। এই সে তাকাচ্ছে বিনুর দিকে। পরমুহূর্তে তার চোখ চলে যাচ্ছে ঝুমার মুখের। ওপর। একবার বিনু। একবার ঝুমা। দু’জনকে দেখতে দেখতে সূক্ষ্মভাবে কিছু একটা বুঝতে চেষ্টা করছে।
আনন্দ সুধা আর ঝুমা এলোমেলো গল্প করে যাচ্ছিল। বিনুকে কিছু বললে খুব সংক্ষেপে সে। উত্তর দিচ্ছে। ঝিনুক প্রায় চুপচাপ। তার চোখ অনবরত দুটি মুখের ওপর পাক খাচ্ছে। আনন্দরা তাকে আড্ডার মধ্যে টেনে আনতে কম চেষ্টা করছে না। ঝিনুক শুধু অন্যমনস্কর মতো হুঁ হাঁ করে যাচ্ছে।