বাতাসে হিম আর কুয়াশা মিশে যাচ্ছে। যেদিকে, যতদূর চোখ যায়, সন্ধে নামার তোড়জোড় চলছে।
বিনুর গা ঘেঁষে ব্যালকনির রেলিংয়ে কনুইয়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঝুমা। তার গা থেকে সেন্টের সেই উগ্র গন্ধটা বিনুর নাকের ভেতর দিয়ে হাড়মজ্জায় ঢুকে যাচ্ছে। মাথা ঝিম ঝিম করছে তার।
ঝুমা বলল, মামা আনতে চাইছিল না। তবু আমি জোর করে চলে এসেছি। কেন জানো?
ঝুমার উত্তরটা মোটামুটি আন্দাজ করে নিয়েছে বিনু। তবু জিজ্ঞেস করল, কেন?
হাঁদারাম, বুঝতে পার না? তোমার জন্যে।
গায়ে কাঁটা দিল বিনুর। এই মেয়েটা যখন সদ্য কিশোরী, একটি চুম্বনে নরনারীর সম্পর্কের অপার রহস্যময় পৃথিবীর দরজা তার সামনে খুলে দিয়েছিল। কোন গহন অভিসন্ধি নিয়ে সে আজ এখানে হাজির হয়েছে, কে জানে।
ঝুমা এবার বলল, ঝিনুক আর সুধা মাসি নেই। ভালই হয়েছে। তোমাকে একলা পাওয়া গেছে। ঝিনুক থাকলে তোমার সঙ্গে কথাই বলা যেত না।
বিনু উত্তর দিল না।
ঝুমা বলতে লাগল, রোজই আশা করে থাকি, আমাদের বাড়ি আসবে। কিন্তু একদিনও এলে না।
বিনু ঝুমার দিকে এক পলক তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নেয়। বলে, এখানে এসে এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছি, এত জায়গায় ছোটাছুটি করতে হচ্ছে যে অন্য কোনও দিকে মন দেবার সময় পাচ্ছি না। সত্যি মিথ্যে মিলিয়ে না-যাবার কারণটা খাড়া করল সে, তা ছাড়া–
কী?
সেদিনই তো বলেছি, কলকাতায় যখন এসেছি, কোথাও না কোথাও তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে।
সে তো ঝিনুক তোমার পাশে বসে ছিল বলে। একটা সত্যি কথা বলবে?
কী?
ঝুমা সোজা বিনুর দিকে তাকায়। তাকিয়েই থাকে। পলকহীন। তার দু’চোখে সম্মোহনের মতো কী যেন ঘন হয়ে আসে। বলে, আমার সঙ্গে দেখা করতে তোমার ইচ্ছা হয় না?
বিনু চুপ করে থাকে।
ঝুমা চোখ সরায় নি। বিনুর মুখের ওপর দৃষ্টি স্থির রেখে বলল, করে। বলতে লজ্জা হচ্ছে, তাই না? তার গলার স্বর চাপা শোনায়।
বিনু এবারও নীরব।
ঝুমা আরেকটু নিবিড় হয়ে আসে। বলে, ঝিনুককে তুমি খুব ভয় পাও। ওর জন্যে আমাদের বাড়ি যাও না। কি, ঠিক বলছি?
বিনু চোখ নামিয়ে নেয়। ঝুমার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারছিল না সে।
ঝুমা হঠাৎ তীক্ষ্ণ গলায় জিজ্ঞেস করে, ঝিনুককে তুমি কলকাতায় নিয়ে এলে কেন?
বিনু হতচকিত। এমন একটা প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিল না। একটু চুপ করে থেকে, আস্তে আস্তে বলল, তুমি জানো না, ওর কত বড় ক্ষতি হয়েছে। পুরোপুরি অ্যাবনর্মাল হয়ে গিয়েছিল। পাকিস্তানে একেবারেই থাকতে চাইছিল না। সারাক্ষণ কান্না আর কান্না। দেশে থাকলে ও মরে যেত। চোখের সামনে একটা মেয়ে ভয়ে আতঙ্কে কেঁদে কেঁদে মারা যাবে, সহ্য করতে পারছিলাম না। কিছুক্ষণ থেমে, গম্ভীর গলায় বলে, মেয়েটা বড় দুঃখী।
ঝুমার মুখচোখ কোমল হয়ে এল। সামান্য অনুতপ্ত কি? ভারী গলায় বলল, জানি ঝিনুক খুব দুঃখী। ওর জন্যে আমারও যথেষ্ট সিমপ্যাথি আছে। কিন্তু–
কী?
অন্য সমস্যাগুলো তুমি বোধ হয় আগে ভেবে দেখ নি?
কোন কোন সমস্যার কথা বলছ?
ঝুমা বুঝিয়ে দিল। একটি ধর্ষিত মেয়ের পক্ষে এই সমাজে টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব। মানুষ এখনও হাজারটা সংস্কারের কুয়োয় আটকে আছে। তার মনের প্রসার কবে ঘটবে, আদৌ ঘটবে কিনা, কেউ জানে না। উদারতা, মহত্ত্ব, এই সব দামী দামী শব্দ বইয়ের পাতাতেই শুধু সাজানো থাকে।
ঝুমা বলতে লাগল, আমার মামাবাড়িতে তো ঝিনুককে নিয়ে গিয়েছিলে। থাকতে পারলে? আমার দিদা কী নিষ্ঠুর ব্যবহার করেছে, সব শুনেছি। সুধামাসিরা শেলটার দিয়েছে, কিন্তু সে আর ক’দিন? হিরণ মেশোর দাদু আর জেঠিমা শিগগির পাটনা থেকে চলে আসবেন। তোমার বাবারও ফিরে আসার সময় হয়েছে। আমার মনে হয় না, ঝিনুকের মতো একটা মেয়েকে ওঁরা কেউ মর্যাদা দিয়ে বাড়িতে থাকতে দেবেন।
এগুলো নতুন কথা নয়। বিনু নিজেও সহস্র বার ভেবেছে। যেটা তাকে অবাক করল, ঝিনুককে নিয়ে সে কোন সংকটে পড়েছে, এবং ভবিষ্যতে তার সমস্যা আরও কতটা ঘোরালো হয়ে উঠবে, সে সম্বন্ধে কুমার ধারণা আছে। তার চিন্তাশক্তি খুবই স্বচ্ছ। মেয়েটাকে যতটা চটুল মনে হোক, আদপে সে কিন্তু তা নয়।
বিনু বলল, পাকিস্তানে এমন একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে যে ওকে না এনে উপায় ছিল না। দাদু আর দিদারাও নিয়ে আসতে বলল। তখন অন্য কিছু ভাবার মতো সময় বা মানসিক অবস্থা কারোর ছিল না।
ঝুমা বলল, সবই বুঝলাম। কিন্তু ঝিনুককে কেউ যখন নিজেদের কাছে থাকতে দেবে না, ওই মেয়েকে নিয়ে কী করবে তুমি? কোথায় যাবে? তা ছাড়া–
এই সব চিন্তা কদিন আগেও অবিরল বিনুকে অস্থির করে রেখেছিল। সুধাদের কাছে এসে কিংবা মুকুন্দপুরে গিয়ে রাজদিয়া এলাকার পরিচিত মানুষজনের মধ্যে একটা দিন একটা রাত কাটিয়ে, তাদের আন্তরিকতায় সে এতই অভিভূত হয়ে পড়েছিল যে ঝিনুককে নিয়ে সংকটের কথা ভাবে নি। কয়েক দিনের জন্য দুশ্চিন্তাটা উধাও হয়ে গিয়েছিল। ঝুমা মনে করিয়ে দিতে মস্তিষ্কের কোনও গোপন কুঠুরি থেকে দঙ্গল বেঁধে সমস্যাগুলো বেরিয়ে এল।
বুকের ভেতর কেমন যেন একটা চাপা অস্বস্তি হচ্ছে। ঝুমা তার পুরনো দুর্ভাবনা এবং ত্রাস ফিরিয়ে এনেছে। মলিন মুখে সে জিজ্ঞেস করে, তা ছাড়া কী?
সারাক্ষণ তুমি ঝিনুককে আগলে আগলে রাখতে পারবে না। মামা তোমার জন্যে চাকরির ব্যবস্থা করেছে। খবরের কাগজেই হোক, বা অন্য কোথাও, কাজ তোমাকে করতেই হবে। অফিসে তো আর ঝিনুককে নিয়ে যেতে পারবে না। তখন সে কোথায় থাকবে?