আনন্দ বিশদভাবে জানায়। তার বাবা যখন হাইকোর্টে প্রাকটিস করতেন, একজন বড় বিজনেসম্যান ছিলেন তার ক্লায়েন্ট। কয়েকটা ইণ্ডাস্ট্রি তাঁর ছিল। ভদ্রলোক অত্যন্ত, বুদ্ধিমান এবং দূরদশী। দেশ চিরকাল পরাধীন থাকবে না, ইংরেজকে সুদূর ভারতবর্ষের কলোনি থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে পালাতে হবে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূর্য পৃথিবীর এই ভূখণ্ডে চিরদিনের মতো অস্তাচলে যাবে বহুকাল আগেই তিনি তার আঁচ পেয়েছিলেন। তখন থেকেই স্বাধীনতা সংগ্রামীদের, সশস্ত্রই হোক বা অহিংস, গোপনে গোপনে অর্থ দিয়ে সাহায্য করে যাচ্ছিলেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ইংরেজদের সংকট যখন দ্রুত ঘনিয়ে আসছে, সাহায্যের মাত্রাটা বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তিনি জানতেন, দেশের রাজ্যপাট একদিন এদের হাতেই আসবে। ব্যবসা বাণিজ্য কলকারখানা চালাতে গেলে নতুন শাসকদের অনুগ্রহ দরকার। অর্জুনের সেই মাছের চোখের মতো লক্ষ্যটা এরকম হলেও, দেশপ্রেম বা আদর্শবাদ তাঁর একেবারেই যে ছিল না তা নয়।
এই বিজনেসম্যান ভদ্রলোক, জগদীশ গুহঠাকুরতা, স্থির করেছেন, একখানা বাংলা দৈনিক কাগজ বার করবেন। অনেক দূর এগিয়েও গেছেন। সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউতে তাঁদের একটা বড় তেতলা বাড়ি আছে। সেখানে অফিস খোলা হয়েছে। প্রেস, লাইনো মেশিন এবং অন্যান্য যন্ত্রপাতি কেনা হয়ে গেছে। সাংবাদিক থেকে শুরু করে নানা ডিপার্টমেন্টে কিছু কিছু লোকও নেওয়া হয়েছে। খুব শিগগির আরও নেওয়া হবে।
খবরটা কানে আসামাত্র বালিগঞ্জে জগদীশবাবুর বাড়ি ছুটেছিল আনন্দ। বাবার জুনিয়র হিসেবে একসময় কিছুদিন হাইকোর্টে আনাগোনা করেছিল সে। তখন থেকেই জগদীশের সঙ্গে আলাপ। মাঝে মাঝে ভদ্রলোক তাদের বাড়িতে আসতেন। এখনও আসেন। আনন্দরাও বিয়ে, অন্নপ্রাশন, শ্রাদ্ধ, লক্ষ্মীপুজো, কালীপুজো, এমনি নানা অনুষ্ঠানে ওঁদের বাড়ি যেত। এখনও যায়। ঘনিষ্ঠ পারিবারিক সম্পর্কের মতো দাঁড়িয়ে গেছে ব্যাপারটা। আনন্দর বাবার মৃত্যু হয়েছে, হাইকোর্টে যাওয়া কবেই
ছেড়ে দিয়েছে সে, তবু জগদীশ গুহঠাকুরতার সঙ্গে যোগাযোগটা থেকেই গেছে।
বিনুর কথা জানানো মাত্র জগদীশ তাকে আজকালের মধ্যে নিয়ে যেতে বলেছেন। আনন্দ জিজ্ঞেস করল, কবে যাবে বল–
বিনু বলল, খবরের কাগজের কাজ তো আমি কিছুই জানি না। এ সম্পর্কে আমার কোনও, ধারণাই নেই।
আনন্দ হাসল, ধর হিরণদের ফুড ডিপার্টমেন্টে কি অন্য কোনও অফিসে তোমার চাকরি হল। সে সব জায়গার কাজকর্ম সম্বন্ধে তোমার ধারণা আছে?
ত নেই।
কাজ করতে করতেই সবাই শিখে নেয়। সুযোগটা যখন এসে গেছে, ছেড়ো না। পরে ভাল চাকরি পেলে এটা ছাড়তে কতক্ষণ?
একটু চিন্তা করে বিনু বলল, ঠিক আছে। কবে যেতে বলছেন?
আজ যেতে পারবে?
বাড়িতে কেউ নেই। ছোটদিদের না জানিয়ে বেরুনো ঠিক হবে না।
তা হলে কালই যাওয়া যাবে।
বিনু আস্তে ঘাড় হেলাল।
আনন্দ বলল, জগদীশবাবু সন্ধেবেলা ওঁদের খবরের কাগজের অফিসে আসেন। তুমি বিকেলে আমাদের বাড়ি চলে এস। আমি আমার অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে বাড়ি থেকে তোমাকে নিয়ে জগদীশবাবুর কাছে চলে যাব।
মুখটা পলকের জন্য থমথমে হয়ে গেল বিনুর। ধীরে ধীরে বলল, আপনার অফিসের ঠিকানাটা দিন। আমি বরং সেখানে চলে যাব। আপনি ওখান থেকে আমাকে নিয়ে যাবেন।
বিনু কেন তাদের বাড়ি যেতে চাইছে না, তার দ্বিধা এবং ক্ষোভটা কী কারণে, সবই বুঝতে পারছে আনন্দ। এ নিয়ে সে কোনও প্রশ্ন করল না। বলল, বেশ। অফিসের ঠিকানাটা লিখে নাও–
কোণের টেবল থেকে কাগজ কলম এনে লিখে নিল বিনু।
উমা একটা ট্রে’তে চা এবং প্রচুর মিষ্টি টিষ্টি দিয়ে গেল। আনন্দর সঙ্গে এ বাড়ির সম্পর্কটা তার খুব ভাল করেই জানা আছে। সুধারা নেই। তাদের ঘনিষ্ঠ পরিজনদের আদরযত্নে বিন্দুমাত্র ত্রুটি হতে দেয় না সে। তা ছাড়া, ঝুমাও নিশ্চয়ই তাকে চায়ের কথা বলেছে।
বিনু শুধু চায়ের কাপটাই তুলে নিয়েছে। দু’এক চুমুক দেবার পর বলল, আমার একটা কৌতূহল হচ্ছে আনন্দদা–
কী কৌতূহল?
জগদীশবাবু তো বললেন কী সব বিজনেস করেন, কলকারখানাও বসিয়েছেন। তিনি হঠাৎ খবরের কাগজ বার করতে চলেছেন কেন?
আনন্দ হাসল, স্বাধীনতার পর খবরের কাগজও তো বিগ বিজনেস হয়ে উঠছে। তবে এর পেছনে ওঁর অন্য কোনও উদ্দেশ্য আছে কিনা, আমার জানা নেই। একটু থেমে ফের বলে, জলে ফেলার জন্যে কেউ লাখ লাখ টাকা ঢালে না।
কথা বলতে বলতে হঠাৎ বিনুর চোখে পড়ল, দরজার বাইরে দেওয়াল ঘেঁষে নিজেকে যতটা সম্ভব আড়ালে রেখে হাতের ইশারায় তাকে ডাকছে ঝুমা। আনন্দ যেখানে বসেছে সেখান থেকে ঝুমাকে দেখা যায় না।
রাজদিয়ায় পুজোর ছুটিতে গিয়ে সেই যে ঝুমা বিনুর নাকে একটা অদৃশ্য বড়শি আটকে দিয়েছিল সেটা এখনও বিধেই আছে। কী যে দুরন্ত, অদম্য আকর্ষণ এই তরুণীর! রক্তস্রোতে চমক খেলে যেতে লাগল বিনুর। যাদুকরীর মতো ক্রমাগত ইঙ্গিতে টেনেই চলেছে সে।
নিজের অজান্তেই যেন উঠে দাঁড়ায় বিনু। আনন্দদা, আপনি চাটা খান। আমি একটু ভেতর থেকে আসছি–
বাইরে আসতেই ঝুমা বিনুকে পেছন দিকের একটা চওড়া ব্যালকনিতে নিয়ে গেল। এখান থেকে ট্রাম রাস্তার দিকের অনেকখানি অংশ দেখা যায়।
বেলা প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। বিবর্ণ, নিস্তেজ সূর্য পশ্চিম দিকের উঁচু উঁচু গাছগুলোর মাথায় এখনও আলগাভাবে আটকে আছে। কিছুক্ষণের মধ্যে ওটা টুপ করে গাছপালার আড়ালে খসে পড়বে।