বাইরের ঘরের এক কোনায় টেবল চেয়ার রয়েছে। সেখানে বসে হিরণের কথামতো অ্যাপ্লিকেশনগুলো লিখছিল বিনু। ভেতরের কোনও একটা ঘরে খুটখাট করে কী যেন করছে উমা।
নিচে থেকে কড়া নাড়ার আওয়াজ ভেসে এল। লিখতে লিখতেই বিনু উমাকে বলল, দেখ তো উমা, কে এসেছে এখন হিরণদের কারও ফেরার কথা নয়। তা হলে কে আসতে পারে?
যাই মামাবাবু–
উমা ব্যস্তভাবে একতলায় চলে গেল। একটু পরে কলকল করতে করতে তার সঙ্গে যে উঠে এল, এই মুহূর্তে কেন, আট দশ দিনের ভেতর তার কথা একবারও ভাবে নি বিনু। দরজার বাইরে ঝুমা। তার পেছনে আনন্দ।
ঝুমাকে দেখামাত্র সারা শরীরে পুরনো সেই শিহরন খেলে যায় বিনুর। টেবল থেকে ত্বরিত পায়ে উঠে সে এগিয়ে আসে, আসুন আনন্দদা, এস ঝুমা–
দু’জনে ঘরে ঢুকে সোফায় বসে পড়ে। বিনুও ওদের মুখোমুখি বসে।
আনন্দ বলে, বাড়ি এত নিঝুম কেন? হিরণ নিশ্চয়ই অফিসে? সুধা আর ঝিনুক কোথায়? ওদের ডাকো–
আমিই ডেকে আনছি–
ঝুমা উঠতে যাচ্ছিল। তাকে থামিয়ে দিয়ে বিনু বলে, ওরা বাড়ি নেই। কোথায় গেছে, কখন ফিরবে, তাও জানিয়ে দিল।
বলতে বলতে বিনু লক্ষ করল, ঝুমার চোখে ঝিলিক খেলে যাচ্ছে। দুই ঠোঁটে রহস্যময় সংকেতের মতো চিকন একটু হাসি ফুটে উঠেই মিলিয়ে যায়। মনে হল, ঝিনুকরা না থাকায় সে খুশিই হয়েছে।
সেদিন কলেজ থেকে সোজা আনন্দদের বাড়ি চলে গিয়েছিল ঝুমা। পরনে সিল্কের শাক্টিাড়ি থাকলেও তেমন একটা সাজে নি। আজ কিন্তু তার শতগুণ সেজে এসেছে। পাঁচ হাত দূরে বসে আছে এক পরমাশ্চর্য স্বপ্নের পরী। নাকি এক কুহকময়ী নারী? ঝুমার শাড়িটাড়ি থেকে সেন্টের তীব্র মিষ্টি গন্ধ উঠে এসে বিনুর স্নায়ুগুলোকে আচ্ছন্ন করে দিচ্ছিল।
বিনু বলল, আপনারা এলেন, বড়দিকে আনলেন না কেন?
আনন্দ বিব্রত বোধ করে, জানোই তো, ওর এখানে আসার অসুবিধা আছে। তাই–
ইঙ্গিতটা স্পষ্ট। হেমনলিনী চান না, ঝিনুক যতদিন সুধাদের কাছে আছে, তাদের বাড়ির মেয়েরা এখানে আসুক। বিনুর মনটা খারাপ হয়ে যায়।
আনন্দ এবার বলল, তোমার জন্যে আজ অফিস ছুটি নিয়েছি।
বিনু অবাক হল, কেন বলুন তো?
বলতেই তো এসেছি। একটু ধৈর্য ধর। আনন্দ বলতে লাগল, বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটা দরকারে ঝুমাদের ওখানে গিয়েছিলাম। ওর কলেজ আজ ছুটি। আমাকে ছাড়ল না। জোর করে সঙ্গে চলে এল।
বিনু উত্তর দিল না। কী কারণে হঠাৎ আনন্দ এসেছে সেটা জানার জন্য সে উদগ্রীব হয়ে থাকে।
ঝুমা ভীষণ চঞ্চল, ছটফটে। এক জায়গায় চুপচাপ স্থির হয়ে কিছুক্ষণ বসা তার ধাতে নেই। হুট করে উঠে পড়ল সে। তোমরা গল্প কর। এ বাড়িতে অনেক দিন আগে সুনীতি মামীর সঙ্গে একবার মাত্র এসেছিলাম। সব মনেও নেই। ঘুরে ঘুরে একটু দেখি। চা খাবে তো?
ঝুমার স্বভাবে অবাধ জলস্রোতের মতো কিছু আছে। সঙ্কোচ, জড়তা বা বাধোবাধো ভাবের লেশমাত্র নেই। যেখানেই যাক, মনে হয়, অনেকদিন ধরে রয়েছে। এ বাড়িতে সুধারা যখন নেই, আনন্দদের আপ্যায়নের দায়িত্ব যেন তারই।
আনন্দ বলল, নিশ্চয়ই খাব। কিন্তু—
ঝুমা বিনুকে জিজ্ঞেস করল, হিরণমামাদের কাজের মেয়েটার নাম যেন কী?
বিনু বলল উমা—
উমাকে চা করতে বলছি’ ঝুমা টুক করে বাইরে বেরিয়ে গেল।
আনন্দ এবার বলল, যেভাবে আমাদের বাড়ি থেকে তোমাদের চলে আসতে হয়েছে, সে জন্যে আমার লজ্জার শেষ নেই। তোমার বড়দি দুদিন খুব কেঁদেছে। আমারও কী খারাপ যে লেগেছে, বলে বোঝাতে পারব না।
আনন্দর দুঃখ বা অনুতাপ যে যথেষ্ট আন্তরিক, বুঝতে অসুবিধে হচ্ছিল না বিনুর। প্রসঙ্গটা অপ্রিয়, অস্বস্তিকর। সেটা এড়ানোর জন্য বলল, ওসব কথা থাক আনন্দদা
আনন্দ আস্তে মাথা নাড়ে, হ্যাঁ, সেই ভাল। এখানে কেমন আছে ঝিনুক?
আগের থেকে অনেক নর্মাল। বেশ হাসিখুশি। পুরনো শকটা প্রায় কাটিয়ে উঠেছে।
পাংশু মুখে খানিকক্ষণ বসে থাকে আনন্দ। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, আমরা পারি নি। হিরণ আর সুধা যে মেয়েটার মুখে হাসি ফোঁটাতে পেরেছে, শুনে খুব ভাল লাগছে।
বিনু উত্তর দিল না।
আনন্দ জিজ্ঞেস করে, শেষ পর্যন্ত কী ঠিক করলে?
বুঝতে না পেরে বিনু বলে, কী ব্যাপারে?
রাজদিয়া থেকে বি.এ পাস করে এসেছ। পড়াশোনাটা চালিয়ে গেলে ইউনিভার্সিটিতে এখনই ভর্তি হতে হয়। আর যদি চাকরি টাকরি কর–
এই কথাটা হিরণও তাকে বলেছে। সে জানালো, চাকরির কথাই ভাবছি আনন্দদা। শুনেছি রিফিউজিদের এ ব্যাপারে গভর্নমেন্ট থেকে বেশ কিছু সুযোগ সুবিধা দিচ্ছে। সেটা নেওয়া উচিত। হিরণদাও তাই বলছিল।
চেষ্টা টেষ্টা করছ?
হিরণদাদের অফিসে অ্যাপ্লাই করেছি। হিরণদা নিজে অ্যাপ্লিকেশনটা নিয়ে গিয়ে জমা দিয়েছে। অন্য অন্য অফিসে পাঠাবার জন্য আরও তিনটে দরখাস্ত লিখতে বসেছিলাম, আপনি আর ঝুমা এসে গেলেন।
হিরণ কী বলছে, ওদের ওখানে হয়ে যাবে?
সবে তো দরখাস্ত জমা পড়েছে। যাতে কাজটা হয়, হিরণদা সেজন্যে লেগে আছে। আমার ইচ্ছে, চাকরি পেলে প্রাইভেটে এম.এটা দিয়ে দেব।
গুড আইডিয়া।
একটু চুপ।
তারপর আনন্দ বলে, আমি একটা চাকরির খবর নিয়ে এসেছি। যদি রাজি হও, এখনই হয়ে যেতে পারে।
অফিস ছুটি নিয়ে এ বাড়িতে আনন্দর আসার উদ্দেশ্যটা এতক্ষণে জানা গেল। বিনুর সর্বাঙ্গে তড়িৎপ্রবাহ বয়ে যায়। হিরণের অফিসে সবে দরখাস্ত জমা পড়েছে। কবে সেখান থেকে ডাক আসবে তার নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু আনন্দর কাজটা পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। উৎসুক সুরে বিনু জিজ্ঞেস করল, কী ধরনের চাকরি?