বিনু পূর্ণ দৃষ্টিতে ঝিনুকের দিকে তাকায়। এই কি সেই ঝিনুক, রাজদিয়া থেকে আসার পর তাকে এক দণ্ড না দেখলে যে কেঁদে কেটে পৃথিবী ভাসিয়ে ফেলত! সে-ই কিনা তাকে যুগলদের কাছে শুধু। আজকের দিনটাই না, আরও কটা দিন কাটিয়ে আসার কথা বলছে! শুনেও বিশ্বাস হতে চায় না।
ঘরে ঢুকে ঝিনুককে যখন রেডিও সিলোন শুনতে দেখেছিল তখনই বিনু বুঝেছে, বেশ আনন্দেই আছে মেয়েটা। মুকুন্দপুরে যে সংশয়টা তার মস্তিষ্কে হুল ফোঁটাচ্ছিল, দেখা যাচ্ছে, সেটার কোনও কারণ নেই। এর ভেতর নিশ্চয়ই সুধাদের বাড়িতে এমন কিছু ঘটে নি বা বাইরের কেউ এসে এমন কিছু বলে নি যাতে ঝিনুক ফের কুঁকড়ে যায়, ফিরে আসে তার সেই দুঃস্বপ্নের স্মৃতি।
ঝিনুককে দেখে খুব ভাল লাগছিল বিনুর। বলল, এমনিই চলে এলাম। আসল হেতুটা তো আর জানানো যায় না।
গভীর আগ্রহে হিরণ জিজ্ঞেস করল, কেমন দেখলে জায়গাটা?
বিনু সবিস্তার সব জানালো।
হিরণ বলে, খুঁজে খুঁজে অমন একটা জায়গা বার করেছে। জঙ্গল কেটে কলোনি বসিয়েছে। সাপখোপ আর জমিদারের গুণ্ডাবাহিনীর সঙ্গে ফাইট করে নিজেদের এস্টাব্লিশ করতে চেষ্টা করছে। সবই আমাকে জানিয়েছে যুগল। কিন্তু তুমি যা ডেসক্রিপশন দিলে, এতটা ভাবতে পারি নি। ইস্ট পাকিস্তান থেকে এসে যারা রিফিউজি ক্যাম্পে আর রেল স্টেশনে ধুকে ধুকে মরছে তাদের যদি যুগলদের মতো সাহস, মনের জোর আর অ্যাডভেঞ্চারাস স্পিরিট থাকত!
মাথা নেড়ে সায় দেয় বিনু।
হিরণ বলতে লাগল, যুগল অনেক বার যেতে বলেছে। নানা কারণে যাওয়া হয় নি। এবার একদিন যেতে হবে।
নিশ্চয়ই যাবেন। গেলে ওরা কী খুশি যে হবে।
শুনতে শুনতে সুধা এবং ঝিনুকের ভীষণ কৌতূহল হচ্ছিল। ঝিনুক জিজ্ঞেস করল,
কিভাবে মুকুন্দপুরে যেতে হয়?
বিনু মজার গলায় বলল, তুমি ওখানে যাবে নাকি?
প্রশ্নটার উত্তর না দিয়ে ঝিনুক বলল, যুগলদা বলেছিল, আমাদের রাজদিয়ার অনেক মানুষ ওখানে গিয়ে ঘরবাড়ি তুলেছে। কারা কারা গেছে?
সকলের নাম বলল বিনু। আরও জানালো শুধু রাজদিয়ারই না, গিরিগঞ্জ সিরাজদীঘা দেলভোগ রসুনিয়া, এমনি নানা জায়গার লোজন ওখানে আছে। সবই পরিচিত মুখ। মুকুন্দপুরে গেলে মনে হবে আরেক রাজদিয়া। যুগলরা পূর্ব বাংলার সেই জনপদটিকে অসীম মায়ায় সীমান্তের এপারে জঙ্গ ল নিমূল করে নতুন করে সৃষ্টি করছে।
ঝিনুক উত্তর দিল না। ভেতরে ভেতরে নিজেকে খানিকটা গুটিয়ে নিয়েছে সে।
মুখচোখের সামান্য পরিবর্তন লক্ষ করে ঝিনুকের মনোভাবটা আঁচ করে নেয় বিনু। রাজদিয়াবাসী যারা মুকুন্দপুরে এসে উঠেছে তারা কি আর রায়টের সময় তার লাঞ্ছনার খবরটা পায় নি? ওদের কাছে যাওয়া ঠিক হবে কিনা, সেই সংশয় তাকে হয়তো বিচলিত করে তুলেছে। বিনু আর কোনও প্রশ্ন করল না।
.
রাতে খাওয়াদাওয়ার পর বিনুকে একলা পেয়ে ঝিনুক নতচোখে কুণ্ঠিতভাবে জিজ্ঞেস করে, যুগলদের ওখানে সবাই কি আমার কথা জানে?
ঝিনুকের মাথায় কোন চিন্তাটা অবিরল ঘুরপাক খাচ্ছে, বুঝতে পারছিল বিনু। সে মনস্থির করে ফেলে। বলে, হা, জানে। কিন্তু ওখানে গেলে তোমার কোনও ভয় নেই।
বিমূঢ়ের মতো ঝিনুক বলে, মানে?
বিনু বুঝিয়ে দেয়, মুকুন্দপুরে তার মতো ধর্ষিত মেয়ে আরও অনেকে আছে। এমনকি পাকিস্তানে বেশ ক’টি যুবতী মেয়েকে জল্লাদেরা কেড়ে নিয়ে যাবার পর তাদের শোকাতুর মা-বাবারা ওখানে এসে উঠেছে।
যে মেয়েরা পাকিস্তানে সম্রম খুইয়ে, অশেষ নির্যাতন ভোগ করে মুকুন্দপুরে এসেছে, কেউ তাদের ঘেন্না করে না। গায়ে থুতু দেয় না। অছুতের মতো দূরে সরিয়ে রাখে না। এইরকম মেয়ে তো একটা দুটো নয়। কে কাকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নেবে? বরং মুকুন্দপুরবাসীরা নিবিড় সহানুভূতিতে, গভীর মমতায় নিজেদের কাছে এদের টেনে নিয়েছে। পাছে ওরা কষ্ট পায়, পুরনো দুঃস্বপ্নের স্মৃতি ফের ওদের আতঙ্কগ্রস্ত করে তোলে, তাই চরম ইত্যানির কথা কেউ মুখেও আনে না।
শুনতে শুনতে মুখ আলোয় ভরে যায় ঝিনুকের। বলে, ওরা তো খুব ভাল
হ্যাঁ। এবার যেতে আপত্তি নেই তো?
না।
.
৩.৩৭
মুকুন্দপুর থেকে ফেরার পর দুদিন কেটে গেল। এর মধ্যে একটা বড় কাজ সেরে ফেলেছে বিনু। শওকত আলিদের খান মঞ্জিল’-এর সঙ্গে তাদের রাজদিয়ার বাড়ি এক্সচেঞ্জ করার কথাবার্তা আগেই মোটামুটি পাকা করে ফেলেছিল হিরণ। কিন্তু সুধা ঘাড় বাঁকিয়ে রেখেছিল, কিছুতেই ও বাড়িতে যাবে না। অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাকে রাজি করিয়েছে বিনু। তবে আরও একটা মস্ত বাধা আছে। হিরণের জেঠিমা। তাঁকে রাজি করানোর দায়িত্ব বিনুর নয়, হিরণের। সুধারও।
.
এখন বিকেল।
হিমঋতু লম্বা পা ফেলে এগিয়ে আসছে। আজকাল দুপুরের পর সূর্য পশ্চিম দিকে একটু ঢলে পড়লেই উত্তুরে হাওয়া দ্রুত জুড়িয়ে যায়। রোদের রং ক্রমশ মলিন হতে থাকে।
বাড়িতে এখন বিনু আর উমা ছাড়া অন্য কেউ নেই। হিরণের ছুটি ফুরিয়ে গেছে। সে অফিসে। সন্ধের আগে ফিরবে না। সুধা ঝিনুককে নিয়ে দুপুরে ভবানীপুরে গেছে। কী সব কেনাকাটা করবে। তারপর ওদিক সেদিক বেড়িয়ে তাদেরও ফিরে আসতে আসতে সন্ধে পেরিয়ে যাবে।
বিনু কাল একটা অ্যাপ্লিকেশন লিখে হিরণকে দিয়েছিল। দরখাস্তের খসড়াটা করে দিয়েছে হিরণ। সে তাদের ফুড ডিপার্টমেন্টে ওটা কালই জমা করেছে। আজ অফিসে বেরুবার সময় আরও তিনটে দরখাস্ত লিখে রাখতে বলে গেছে। একটা দেওয়া হবে ইরিগেশন ডিপার্টমেন্টে, একটা পি ডরু ডি’তে, আর একটা এক্সাইজে। কোথায় চাকরি হবে তা তো বলা যায় না। চেষ্টা করতেই হবে। পাকিস্তান থেকে উৎখাত হয়ে এসেছে বিনু। বর্ডার স্লিপও পেয়েছে। চাকরি বাকরি একটা কিছু জুটেও যাবে। সমস্যা অবশ্য আছে। তার ডিগ্রি টিগ্রিগুলো খোয়া গেছে। নিত্য দাসও এর ভেতর আসে নি। সে না এলে হেমনাথকে খবর পাঠিয়ে ডিগ্রিগুলোর ব্যবস্থা করা যাবে না। তবে অ্যাপ্লিকেশন দেবার সঙ্গে সঙ্গেই তো ইন্টারভিউর জন্য ডাক আসবে না। আশা করা যায়, তার মধ্যে কিছু একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। হিরণ সেইরকম আশার কথা শুনিয়েছে। তারপর দেখা যাক।