সুধা আর কিছু বলল না। মুখ দেখে মনে হল না খুব একটা ভরসা পেয়েছে।
এদিকে স্টিমারটা জেটিঘাটের দিকে যত এগিয়ে চলেছে, যাত্রীদের ব্যস্ততা ছোটাছুটি শুরু হয়ে গেছে। আগের সেই মৃদু অস্পষ্ট গুঞ্জনটা হইচই, হট্টগোলের রূপ নিয়েছে। ধুপধাপ শব্দ, বাক্স-প্যাটরা টানাটানির আওয়াজ, চেঁচামেচি, চিৎকার। নিমেষে চারদিক চকিত হয়ে উঠল।
বিনু ভাবছিল পরশু দিন এই সময়টা তারা ছিল কলকাতায়, ভবানীপুরের বাড়িতে। দুপুর থেকে মালপত্র বাঁধাছাঁদা, গোছগাছ আরম্ভ হয়েছিল। তারপর সন্ধেবেলা শিয়ালদা গিয়ে ঢাকা মেল ধরেছে। কাল সকালে এসেছিল গোয়ালন্দ। সেখানে থেকে এই স্টিমারটায় পাড়ি জমিয়েছে। কাল রাত্তিরেই তাদের রাজদিয়া পৌঁছে যাবার কথা। কিন্তু বিপদ বাধিয়েছিল নদীর একটা চড়া। আট দশ ঘন্টার মতো স্টিমারটাকে আটকে রেখেছিল।
সে কি আজকের কথা! খুব ছেলেবেলায় যেটাকে বলা যায় চেতনার প্রত্যুষ, সেই তখন থেকে রাজদিয়ার নাম শুনে আসছে বিনু।
বিনুর জন্ম কলকাতায়। পুবে বেলেঘাটা, পশ্চিমে বড় গঙ্গা, উত্তরে বাগবাজার, দক্ষিণে টালিগঞ্জ কলকাতার চার সীমার ভেতর এত মজা, এত চমক, এত ঘটনার মেলা সাজানো যে যুগযুগান্ত কাটিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু অবনীমোহন মানুষটা স্বভাব-যাযাবর, কোথাও যদি দুটো দিন পা পেতে বসেন! হাতে কটা দিন ফালতু এসে গেল তো সংসার তুলে নিয়ে পাড়ি দিলেন রাজপুতানায় কি সৌরাষ্ট্রে, মগধে অথবা কোশলে। বার বছরের ছোট্ট জীবনে অনেক দেশ দেখেছে বিনু। ছোটনাগপুরের বনভূমি, দাজিলিং-পাহাড়, কাশীর গঙ্গার ঘাট, প্রয়াগে কুম্ভমেলা, অজন্তার গুহায় গুহায় চমৎকার চমৎকার সব শিল্প এবং আরও কত কী। কিন্তু এত কাছের রাজদিয়াটাই শুধু দেখা হয় নি। অথচ কত আগেই না তারা এখানে আসতে পারত!
পুজোর সময়টা প্রতি বছর কলকাতায় দাদুর চিঠি যায়, তার ইচ্ছা একবার অন্তত বিনুরা রাজদিয়ায় বেড়াতে আসুক। চিঠি এলেই মা বলতেন, চল না, এবার ওখানে ঘুরে আসি। ফি বছর যেতে লিখছেন। বাবা বলতেন, এ বছরটা থাক। গিরিডিতে একটা বাড়ি ঠিক করে ফেলেছি। আসছে বার না হয় রাজদিয়া যাওয়া যাবে। মায়ের ইচ্ছা-অনিচ্ছা এত ক্ষীণ যে, বাবার ওপর দাগ কাটতে পারত না। দ্বিতীয় বার তিনি আর এ ব্যাপারে অনুরোধ করতেন না।
প্রতি বছর মায়ের রাজদিয়ামুখি মনটাকে অবনীমোহন একরকম জোর করে অমরকন্টকে, নৈনিতালে কিংবা মধুপুরের দিকে ফিরিয়ে দিতেন। এবার কী খেয়াল হয়েছে, টিকিট কেটে ঘর সংসার তুলে নিয়ে ঢাকা মেলে গিয়ে উঠেছেন। বাবা হয়তো ভেবে থাকবেন, বৃদ্ধ মানুষটি বার বার অনুরোধ করেছেন অথচ একবারও যাওয়া হচ্ছে না। এটা উচিত নয়। অনুচিত তো বটেই,অন্যায়ও।
বিনু শুনেছে, দাদুর সঙ্গে সম্পর্কটা খুব কাছের নয়। মায়ের কিরকম মামা হন। কিন্তু কে বলবে তিনি আপনজন নন।
বার বছরের বিনু ক্লাস সেভেনে পড়ে। অনেক কিছু বুঝতে পারে সে। তার অনুভবের সীমা বহুদূর বিস্তৃত। দাদুর চিঠি সে পড়েছে। সেগুলোতে যে আন্তরিকতা, যে স্নেহপূর্ণ মাধুর্যের সুরটি থাকে, বিনুকে তা অভিভূত করেছে। কোনওদিন দাদুকে দেখে নি বিনু, লু মনে হয়েছে তার মতো মমতাময়, মধুর মানুষ জগতে খুব বেশি নেই। রাজদিয়া বার বার তাকে গোপনে হাতছানি দিয়ে গেছে।
দেখতে দেখতে রোদ উঠে গেল। সূর্যটা কোথায় লুকিয়ে ছিল, জলের তলার কোন অজানারহস্যময় দেশ থেকে যেন হঠাৎ লাফ দিয়ে বেরিয়ে এসেছে। নরম সাদা রেশমের মতো যে কুয়াশার চাদরটা আকাশ এবং নদীকে আবছাভাবে ঢেকে রেখেছিল, এখন আর তা নেই। নদী জুড়ে কত যে ঢেউ! সোনার টোপর মাথায় দিয়ে তারা টলমল করে চলেছে। আকাশটা এতক্ষণে স্পষ্ট হয়েছে। আশ্বিনের অগাধ, অসীম নীলাকাশ।
নীলাকাশ কি আগে আর দেখে নি বিনু? কলকাতার আকাশ অবশ্য বার মাস ধুলোয় ঢাকা, ধোঁয়ায় মাখা। কিন্তু বাবার সঙ্গে যখন বাইরে বেড়াতে গেছে, নির্মল আকাশ কতবার তার চোখে পড়েছে। শিলং পাহাড়ের মাথায় যে আকাশ, লছমনঝোলায় যে আকাশ কিংবা চিরিমিরিতে যে আকাশ, সবই তো মনোরম। কিন্তু এখানকার মতোটি আগে আর কখনও দেখে নি বিনু। আকাশ যে এত উজ্জ্বল, এত ঝকঝকে, নীলকান্ত মণির মতো এমন দীপ্তিময়, কে জানত! তার গায়ে থোকা থোকা ভারহীন সাদা মেঘ জমে আছে। শরৎকালটা যেন তার সবটুকু বিস্ময় নিয়ে বিনুর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
বিশাল রাজহাঁসের মতো দুলতে দুলতে গম্ভীর বাঁশি বাজিয়ে স্টিমারটা একসময় জেটিঘাটে গিয়ে ভিড়ল। সঙ্গে সঙ্গে নোয়াখালি জেলার মাল্লারা বিচিত্র সুর করে মোটা মোটা কাছি ছুঁড়ে দিতে থাকে। জেটিতে আরেক দল মাল্লা তৈরিই ছিল, কাছি লুফে মুহূর্তে লোহার থামে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে আষ্টে পৃষ্ঠে বেঁধে ফেলল। বাঁধাছাঁদা হলে খালাসিরা কাঠের ভারী গ্যাংওয়ে ফেলে জেটির সঙ্গে স্টিমারটাকে জুড়ে দিল।
জেটিঘাটে অনেক মানুষ। গাদাগাদি করে উগ্রীব দাঁড়িয়ে আছে। সবার চোখ এদিকে। এই স্টিমারে যারা এল, খুব সম্ভব তাদের নিতে এসেছে ওরা।
স্টিমারটা জেটিতে ভিড়বার আগে থেকেই চাঞ্চল্য শুরু হয়েছিল। এখন সেটা তুমুল হয়ে উঠেছে। রেলিঙের কাছে যে ভিড়টা ছিল, দ্রুত পাতলা হয়ে ডেকে, কেবিনে আর বাঙ্কে ছড়িয়ে পড়েছে। ওদিকে জেটি থেকে একদল হিন্দুস্থানী কুলি বর্গীর মতো হানা দিয়েছে। একটু পর কুলিদের মাথায় মালপত্র চাপিয়ে যাত্রীমিছিল গ্যাংওয়ে বেয়ে জেটির দিকে নামতে লাগল।