অবনীমোহনের বয়স পঞ্চাশের মতো। বেশ লম্বা, সুপুরুষ। মোটা ফ্রেমের চশমার ভেতর বড় বড় দূরমনস্ক চোখ। এত বয়সেও গায়ের রং উজ্জ্বল। চামড়া টান টান, একটি ভাজও তার ওপর পড়ে নি। চুল উষ্কখুষ্ক, সাদা-কালোয় মেশানো। সাদার ভাগটা কম, তবু ওই রংটা তার চেহারায় নতুন মহিমা এনে দিয়েছে।
সুনীতির বয়স একুশ, সুধার আঠার। দু’জনের চেহারার ছাঁচ একরকম। ভুরু এত সুন্দর আর সরু, মনে হয়, খুব যত্ন করে তুলি দিয়ে আঁকা। সুনীতি ফর্সা না, শ্যামাঙ্গী। কচিপাতার কোমল আভার মতো কী যেন তার গায়ে মাখানো। সুধার রং টকটকে, তার দিকে তাকিয়ে পাকা ধানের কথা মনে পড়ে যায়। দু’জনেরই হাত-পা-আঙুল, সবেতেই দীঘল টান। পানপাতার মতো মুখ, থাক থাক কোঁচকানো চুল, ছোট্ট কপাল আর সরু চিবুকে মনোরম একটি ভঁজ। দু’জনের চোখই টানা টানা, আয়ত। সুনীতির কুচকুচে কালো মণিদুটো যেন ছায়াচ্ছন্ন সরোবর। সুধার চোখের মণি কালো নয়, নীলচে।
সুনীতির দিকে তাকালেই টের পাওয়া যায়, সে বয়স-সচেতন। এর মধ্যেই চেহারায় গম্ভীর ভাব এনে ফেলেছে। সুধা কিন্তু একেবারে উলটো–নিয়ত ছটফটে, চঞ্চল। গাম্ভীর্য বলে কোনো শব্দ তার হাজার মাইলের ভেতরে নেই। অকারণ ছটফটানি আর ছেলেমানুষি সবসময় তাকে ঘিরে আছে।
দু’চোখে অপার বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে বিনু। স্টিমার এখন যেখানে, সেখান থেকে নদীর তীর খুব কাছে, আধ মাইলের মধ্যে। গাছপালা, সবুজ বনানী, ফাঁকে ফাঁকে দু’একটা বাড়িঘর চোখে পড়ছে। অন্য পাড়টা অনেক দূরে, ধুধু, দুর্বল রেখায় আঁকা জলছবির মতো অস্পষ্ট।
নদীর ঠিক মাঝখানটায় ঝাঁপসা কুয়াশার ভেতর অসংখ্য কালো কালো বিন্দু বিচিত্র সংকেতের মতো ছড়িয়ে আছে। মা বলেছেন ওগুলো জেলেডিঙি, সারারাত নদীময় ঘুরে ঘুরে নাকি ইলিশ মাছ ধরে। দূর-দূরান্তের ডিঙিগুলোই না, ছইওলা অনেক নৌকো লক্ষ্যহীনের মতো কাছাকাছি ঘোরাঘুরি করছে। স্টিমার যত আস্তেই চলুক, নদী তোলপাড় করে উঁচু-উঁচু পাহাড় প্রমাণ ঢেউ উঠছে আর নৌকোগুলো মাতালের মতো অনবরত টলছে।
নদী জুড়ে আরেকটা দৃশ্য চোখে পড়ছিল। চাপ চাপ, ঝক ঝক কচুরিপানা বেগুনি ফুলের বাহার ফুটিয়ে ভেসে যাচ্ছে।
বিনুরাই শুধু নয়, প্রায় সব যাত্রীই রেলিঙের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। ফলে স্টিমারের এদিকটা অনেকখানি কাত হয়ে গেছে।
যাত্রীরা সবাই প্রায় কথা বলছিল। কে যেন গলা চড়িয়ে কাকে ডাকল, কেউ কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে সরু করে শিস দিচ্ছে, হঠাৎ উচ্ছ্বাসে কেউ এক কলি গেয়ে উঠল। টুকরো টুকরো কথা, শিসের আওয়াজ-মিলে মিশে একাকার হয়ে মৃদু গুঞ্জনের মতো অনেকক্ষণ ধরে বিনুর কানে বেজে চলেছে। বাবা আর দিদিরাও কী যেন বলাবলি করছে, বিনু বুঝতে পারছিল না। সে শুধু তাকিয়ে আছে। অসীম বিস্ময় ছাড়া তার আশেপাশে আর কিছুই নেই এখন।
নদী বলতে বিনুর অভিজ্ঞতায় কলকাতার বড় গঙ্গাই শেষ কথা। হাওড়া পুলের ওপর দাঁড়িয়ে যতবার গেরুয়া রঙের প্রবাহটি দেখেছে ততবারই সে অবাক হয়ে গেছে। কিন্তু এখানে এই পারাপারহীন জলরাশির দৃশ্য তাকে যেন বিহ্বল করে ফেলেছে।
একসময় অবনীমোহনের ডাক শোনা গেল, বিনু–
বিনু সাড়া দিল না। দু’চোখ মেলে যেমন দেখছিল, দেখতে লাগল।
অবনীমোহন আবার ডাকলেন।
নদীর দিকে চোখ রেখে অন্যমনস্কের মতো সাড়া দিল বিনু, কী বলছ?
আমরা এসে গেছি। ওই যে দেখতে পাচ্ছিস, মনে হচ্ছে ওটাই রাজদিয়ার স্টিমারঘাট। ওখানে আমাদের নামতে হবে। অবনীমোহন সামনের দিকে আঙুল বাড়িয়ে দিলেন।
অবনীমোহনের আঙুল যেদিকে, বিনুর চোখ এবার সেদিকে ঘুরে গেল। এখনও বেশ খানিকটা দুরে, তবু নিশ্চল জেটি, দুতিনটে গাধাবোট, লোকজনের চলাফেরায় বড়সড় একটা গঞ্জের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। বিনুর ছোট্ট বুকের ভেতর সিরসিরিয়ে আনন্দের ঢেউ খেলতে লাগল। শেষ পর্যন্ত রাজদিয়ায় আসা হল তা হলে। কতকাল ধরে মা’র মুখে ওই জায়গাটার কথা শুনে আসছে সে। রাজদিয়ায় আসার ইচ্ছা তার অনেক দিনের।
ওধার থেকে বড়দি সুনীতি বলল, এক্ষুনি স্টিমার জেটিঘাটে ভিড়বে। চল বাবা, কেবিনে গিয়ে মালপত্তর গুছিয়ে নিই।
অবনীমোহন বললেন, তাড়া কি, রাজদিয়াই তো লাস্ট স্টেশন। ওখানে গিয়ে স্টিমারটা নিশ্চয়ই বেশ কয়েক ঘন্টা পড়ে থাকেবে। ধীরেসুস্থে লটবহর গুছোলেও চলবে।
ছোটদি সুধা ব্যস্ত গলায় বলল, দাদু আমাদের নিতে স্টিমারঘাটে আসবেন তো?
অবনীমোহন বললেন, নিশ্চয়ই আসবেন।
তোমার চিঠি দাদু পেয়েছেন?
পাওয়া উচিত। আজ কী বার?
মনে মনে হিসেব করে সুধা বলল, বুধবার।
অবনীমোহন বললেন, গেল বুধবারে জি.পি.ও’তে গিয়ে ডাকে দিয়েছি। সাতদিনে চিঠিটা কি আর আড়াই শ’, তিন শ’ মাইল রাস্তা পেরুতে পারে নি?
সুধা বলল, আরেকটা কথা ভেবে দেখেছ?
কী রে?
আমাদের তো কাল পৌঁছবার কথা ছিল। স্টিমার চড়ায় আটকে গিয়েছিল বলে আজ এলাম। তোমার চিঠি যদি পেয়েও থাকেন দাদু, কাল এসে ঘুরে গেছেন। জেটিঘাটে আজ আর কি আসবেন?
আসবেন রে, আসবেন।
সুধাটা চিরদিনের ভীতু। তার খুঁতখুঁতুনি কাটল না, দাদু না এলে কী যে হবে! তুমি তো আবার কখনও এখানে আসো নি। রাজদিয়ার রাস্তাঘাট কিছুই চেন না।
অবনীমোহন হেসে ফেললেন, তোকে অতশত ভাবতে হবে না। দাদু আসবেনই, দেখে নিস। আর যদি না-ই আসেন, ঠিকানা তো জানি। খুঁজে ঠিক বার করে ফেলব। তা ছাড়া আমি না চিনি, তোর মা চেনে। বারকয়েক সে এখানে এসেছে।