চোখাচোখি হতেই সে হাতছানি দিল। পায়ে পায়ে বিনু কাছে এগিয়ে এল। বলল, ডাকছ কেন?
ছোকরার বয়স কুড়ি একুশের মধ্যে। চওড়া হাড়, মোটা মোটা আঙুল, প্রকাণ্ড বুক, সরু কোমর সবই তার বলশালিতার প্রতীক। গায়ের রং রোদে পুড়ে পুড়ে তামাটে। চুলগুলো খাড়া খাড়া, দুর্বিনীত। তেলে-জলে অথবা চিরুনিতে কোনওদিন তাদের বশ মানানো যাবে, তা যেন নেহাতই দূরাশা। পরনে ভিজে সপসপে এক টুকরো টেনি, কোমরের কাছটায় কোনওরকমে জড়ানো। এছাড়া আর কিছুই নেই। বড় বড় ড্যাবড্যাবে দুটো চোখ সরলতায় মাখা।
দু’পাটির সবগুলো দাঁত মেলে দিয়ে হাসল ছোকরা। বলল, আপনেরা কইলকাতা থিকা (থেকে) আইলেন?
স্টিমারে আসতে আসতে বাংলাদেশের এ প্রান্তের আঞ্চলিক ভাষা শুনেছে বিনু, বিচিত্র উচ্চারণগুলি লক্ষ করেছে। যা শুনেছে তার সিকিও বোঝে নি। তবে সব মিলিয়ে তার খুব মজা লেগেছে, ভালও লেগেছে। সেটা খুব সম্ভব নতুনত্বের জন্য, বৈচিত্রের জন্য।
ছোকরা যা বলল, প্রথমটা বুঝতে পারল না বিনু। অনেকটা অনুমানের ওপর ভরসা করে বলল, কলকাতার কথা বলছ?
হ। ছোকরা মাথা নাড়ল, কইলকাতা মেলা (অনেক) দুরে, না?
এবার বুঝতে পারল বিনু। বলল, হ্যাঁ।
কয়দিন লাগে যাইতে?
মনে মনে হিসেব করে বিনু বলল, দেড় দিনের মতো।
যাইতে হইলে ইস্টিমারে চড়ন লাগে?
হ্যাঁ।
রেলগাড়িতে?
হ্যাঁ। ছোকরার চোখ চকচক করতে লাগল, জানেন আমি কুনোদিন রেলগাড়ি দেখি নাই।
করুণাই হল বিনুর। বলল, রেলগাড়ি দেখ নি! কেন, তোমাদের এখানে রেলগাড়ি নেই?
না। আছে হেই ঢাকার শহরে। অমি কুনোদিন ঢাকায় যাই নাই।
একটু চুপচাপ। তারপর ছোকরা আবার শুরু করল, আইচ্ছা ছুটোবাবু—
কী বলছ?
কইলকাতা তো পেল্লায় শহর, না?
এবারও আন্দাজে বুঝে নিল বিনু। বলল, হ্যাঁ।
কত বড় কন দেখি। ছোকরা সাগ্রহে শুধলো, আমাগো রাইজদা আপনে দেখছেন?
রাইজদা অর্থাৎ রাজদিয়া। বিনু বলল, সবটা দেখি নি। আসতে আসতে যেটুকু চোখে পড়েছে, দেখেছি।
ছোকরা বলল, এই ধারে আর কতটুক! উইধারে এইর ডাবল, তিন ডাবল। আইচ্ছা, কয়খান রাইজদা একলগে করলে একখান কইলকাতা হয়?
নাক কুঁচকে তাচ্ছিল্যের সুরে বিনু বলল, হাজার হাজার।
চোখ দুটো গোল হয়ে গেল ছোকরার। অবাক বিস্ময়ে বলল, ক’ন কী!
ছোকরা আপনি’ আপনি’ করছে। এত মর্যাদা দিয়ে আগে আর কেউ তার সঙ্গে কথা বলে নি। মনে মনে নিজেকে রীতিমতো বিশিষ্ট আর সম্মানিত মনে হচ্ছে। বিনু বলল, একবার গিয়ে দেখে এস না।
কইলকাতা যাওনের সাইদ্য কি আমাগো আছে? মুখখানা ভারি বিমর্ষ হয়ে গেল ছোকরার।
বিনু এবার কিছু বলল না।
ছোকরা আবার বলে, কইলকাতায় মেলা গাড়ি ঘুড়া না?
বিনু বলল, অনেক।
মেলা মানুষ। শুনছি মাইনষের মাথা মাইনষে খায়। রাস্তাগুলান নিকি দিনরাইত ঘইষা মাইজা ঝকঝইকা কইরা রাখে। এতটুক ধুলা কুনোখানে পইড়া নাই। রাইতগুলি নিকি বাত্তিতে বাক্তিতে (আলোয় আলোয়) দিন হইয়া যায়। সত্য ছুটোবাবু?
পূর্ব বাংলার সুদূর অভ্যন্তরে এই রাজদিয়াতে একটি গ্রাম্য যুবকের কল্পলোকে কলকাতা স্বর্গ হয়ে আছে। তার কল্পনা কতদূর আর পৌঁছুতে পারে! সগর্বে বিনু তার চাইতে হাজার গুণ চমকপ্রদ আর বিস্ময়কর এক কলকাতার এমন বর্ণনা দিল যাতে ছোকরা একেবারে হাঁ হয়ে গেল।
বিস্ময়ের ঘোর কিছুটা কমে এলে ছোকরা বলল, আহা রে, অ্যামন দ্যাশ চৌখে দেখতে পাইলাম না! মনিষ্য জনমই ব্রেথা।
হঠাৎ বিনুর একটা কথা মনে পড়ে গেল। তাড়াতাড়ি সে বলে উঠল, তখন তোমরা দুজন এখানে কাজ করছিলে না?
হ। আমি আর করিমা।
করিমা অর্থে করিম। বিনু বলল, তোমার নাম তা হলে যুগল?
ছোকরা অবাক হয়ে বলল, আমার নাম ক্যামনে জানলেন ছুটোবাবু?
তখন ঘোড়ার গাড়ি থেকে তোমরা বাক্স-টাক্স নামাচ্ছিলে, কে যেন তোমাদের নাম ধরে ডাকছিল। তাই শুনে জেনেছি।
যুগল বলল, অ।
বিনু শুধলো, করিমকে তো দেখছি না।
অগো (ওদের) বাড়িত্ গ্যাছে। দুফারে আইব।
একটু ভেবে বিনু কী বলতে যাবে, সেই সময় হঠাৎ ঘুরে পুকুরের দিকে তাকাল যুগল। দেখেই বোঝা যায়, তার চোখমুখ এবং স্নায়ুমণ্ডলী প্রখর হয়ে উঠেছে। স্থির দৃষ্টিতে একটুক্ষণ তাকিয়ে থাকল যুগল। তারপর আচমকা উঠে দাঁড়িয়ে উধ্বশ্বাসে সেদিকে ছুটল।
বিনু জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে? অমন করে ছুটছ কেন?
যুগলের উত্তর দেবার সময় নেই, সে ফিরেও তাকাল না। ছুটতে ছুটতে ঝপাং করে পুকুরের জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। পিছু পিছু বিনুও ছুটে এসেছিল, ঘাটের কাছে এসে সে থমকে দাঁড়িয়ে গেল।
ফিটনে আসতে আসতে মনে হয়েছিল পুকুরের ওপারে শুধু ধানবন। কাছাকাছি আসতে বিনু দেখতে পেল, তার তিন দিকেই ধানের খেত। প্রকাণ্ড মাছের মতো জল কেটে কেটে কোনাকুনি পুকুর পাড়ি দিয়ে নিমেষে ওপারে চলে গেল যুগল। তারপর ধানখেতের ভেতর ডুব দিয়ে অনেকক্ষণ কোথায় অদৃশ্য হয়ে রইল।
ভয়ে বুকের ভেতরটা ঢিপ ঢিপ করতে লাগল বিনুর। যুগল ডুবে গেল নাকি? যদি আর সে জলের তলা থেকে না ওঠে আসে! বিনু একবার ভাবল, ধানখেতে গিয়ে যুগলকে খুঁজে বার করে। পরক্ষণেই তার মনে পড়ল, সে সাঁতার জানে না। সঙ্গে সঙ্গে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল।
ত্রাসে আর উদ্বেগে কতক্ষণ নিশ্বাস বন্ধ হয়ে ছিল, মনে নেই। একসময় ধানখেতের ফাঁকে যুগলের মাথা ভেসে উঠল। তাকে দেখতে পেয়ে আস্তে আস্তে ভয়টা কাটল বিনুর। না, ডুবে যায় নি। অনেকক্ষণ পর জোরে জোরে বুকের ভেতর শ্বাস টানতে লাগল সে।