স্নেহলতা বললেন, তুই কি ওকে মেরে ফেলতে বলিস রমু?
তার মানে!
পরশু দিন ওর বাপ এখানে দিয়ে গেছে। আসা থেকে খালি খাচ্ছেই, খাচ্ছেই। কাল সারারাত পেটের ব্যথায় ঘুমোতে পারে নি, আমাদেরও ঘুমোতে দেয় নি। খাওয়ায় একটু টান না দিলে বুঝলি না, পরের দায়িত্ব
স্নেহের সুরে সুরমা বললেন, ছেলেমানুষ, বায়না করছে। এখন তো দাও, পরে না হয় দিও না।
কী আর করা, ঝিনুকের দাবি অনুযায়ী রসগোল্লা আর কলা তার পাতে তুলে দিতে হল।
একটু নীরবতা।
হঠাৎ কিছু মনে পড়ে যেতে সুরমা বললেন, আচ্ছা মামী—
কী বলছিস? মুখ ফিরিয়ে স্নেহলতা সাড়া দিলেন।
ঝিনুকের বাবা ওকে তোমার কাছে দিয়ে গেছে, বললে না?
হ্যাঁ।
কেন?
ওর মা’কে নিয়ে ওর বাপ ঢাকায় গেছে।
ঢাকায় কী?
ঝিনুকের মামাবাড়ি।
সুরমা অবাক। বিস্ময়ের সুরে বললেন, মামাবাড়িতে গেল, মেয়েটাকে নিয়ে গেল না?
ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন স্নেহলতা। বিষণ্ণ সুরে বললেন, না।
কেন?
কী যেন ভর করে বসল স্নেহলতার ওপর। নিজের অজ্ঞাতসারেই বুঝিবা ফিসফিসিয়ে বললেন, ওর বাপ চিরকালের মতো ওর মাকে রেখে আসতে গেছে।
সে কী!
যা, বড় অশান্তি হচ্ছিল বাড়িতে। তার চাইতে এই ভাল হয়েছে–
অবনীমোহন সুধা সুনীতি সবাই চকিত হয়ে ঝিনুকের দিকে তাকাল। যে মেয়ে খাওয়া নিয়ে এত বায়না করছিল, এখন আর সে খাচ্ছে না। ঝিনুকের চোখের তারা স্থির, টসটস করছে। পলকহীন সে স্নেহলতার দিকে তাকিয়ে আছে। লাল টুকটুকে পাতলা ঠোঁট দুটো থরথর করছে তার।
সুরমা বললেন, তোমার কাছে তো রেখে গেছে। ওদের বাড়িতে আর কেউ নেই?
না। কাকা জ্যাঠা ঠাকুমা ঠাকুরদা, কেউ না থাকার ভেতর বাপ-মা আর ওই একটা মাত্র মেয়ে। তাও–
এই সময় হিরণ ডেকে উঠল, ঠাকুমা—
হিরণের স্বরে এমন কিছু ছিল, স্নেহলতা চমকে উঠলেন।
খুব চাপা গলায় হিরণ আবার বলল, ঝিনুকের সামনে এ সব কথা বল কেন? বুঝবার মতো বয়েস ওর হয়েছে। মুখচোখের চেহারা দেখছ মেয়েটার?
চকিতে একবার ঝিনুককে দেখে নিয়ে স্নেহলতা বললেন, আমারই অন্যায় হয়ে গেছে। থাক, ওসব কথা থাক–
সবার চোখ ঝিনুকের দিকে। বিনুও তাকে দেখছিল। দেখতে দেখতে দাদুর কথাগুলো মনে পড়েছিল। স্টিমারঘাটে দাদু বলেছিলেন, ঝিনুক খুব দুঃখী।
এরপর আর কোনও কথা হল না। একসময় নিঃশব্দে খাওয়ার পালা চুকল।
.
পুবদুয়ারী সেই প্রকান্ড ঘরখানার একধারে তক্তপোশ পাতা। ইতস্তত দু’চারখানা চেয়ারও ছড়িয়ে আছে। খাওয়াদাওয়ার পর অবনীমোহন সুধা আর হিরণ এখানেই আসর বসালেন। সুনীতি আর সুরমা স্নেহলতা শিবানীর সঙ্গে ভেতর দিকে রান্নাঘরে চলে গেলেন। ঝিনুকও তাদের সঙ্গে গেল। সুরমা এখনও খান নি। রান্নাঘরে মামী আর মাসির সঙ্গে কথা বলতে বলতে খাবেন। বিনু হিরণদের কাছেই থেকে গেল।
অবনীমোহন সুধা আর হিরণ গল্প জুড়ে দিল। নিমেষে মশগুলও হয়ে গেল। অবনীমোহন আর সুধা পূর্ব বাংলার এই ভূখণ্ডটি সম্বন্ধে নানা প্রশ্ন করছে। বিপুল উৎসাহে উত্তর দিয়ে যাচ্ছে হিরণ।
কিছুক্ষণ বসে বসে তাদের কথা শুনল বিনু, তারপর দূরমনস্কের মতো জানালার বাইরে তাকাল। এখান থেকে আদিগন্ত সেই ধানবন চোখে পড়ছে, আর দেখা যাচ্ছে আশ্বিনের টলোমলো, অথৈ, অগাধ জল। আকাশের একটা টুকরোও দৃষ্টিতে ধরা দিয়েছে। সারা বর্ষা বৃষ্টিতে ধুয়ে ধুয়ে আকাশ এখন আশ্চর্য নীল। সেখানে কেউ ভারহীন সাদা মেঘের ভেলা ভাসিয়ে রেখেছে। দূর আকাশ, অফুরন্ত জল আর শরতের মেঘদল যেন অবিরাম হাতছানি দিয়ে যাচ্ছে।
আড়ে আড়ে একবার হিরণদের আসরটা দেখে নিল বিনু, সবাই বিভোর হয়ে আছে। সুযোগটা হাতছাড়া কারা সমীচীন নয়। পায়ে পায়ে সুধাদের অলক্ষ্যে বেরিয়ে পড়ল সে।
শালিকের মতো চঞ্চল পায়ে কিছুক্ষণ উঠোনে ঘুরল বিনু। দোলমঞ্চ দেখল, রাসমঞ্চ দেখল, পালা-সাজানো খড়ের স্থূপ দেখল। আর দেখল সারি সারি ধানের ডোল (গোলা)। ফিটন দুটো এখন আর নেই, তারা বোধহয় চলে গেছে। একটু পর কিসের একটা স্রোত তাকে একটানে বাইরের বাগানটার দিকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল।
খানিক আগে এখান দিয়েই এসেছিল বিনু। জায়গাটা তার চেনা। চারদিকে আমগাছ জামগাছ লিচুগাছ কামরাঙা গাছ-সব এক পায়ে দাঁড়িয়ে। বাগানটা ছায়াচ্ছন্ন। মাটি নরম, ভিজে ভিজে। গাছগাছালির ফাঁকে ফাঁকে পাখিদের চেঁচামেচি আর ডানা ঝাঁপটানোর শব্দ। ভিজে মাটির গন্ধ, দূর ধানখেতের গন্ধ, ফুলের গন্ধ–সমস্ত একাকার হয়ে যেন ঘুম ঘনিয়ে আনে।
গাছপালার পাশ দিয়ে, লতাপাতার ধার দিয়ে, ঝোঁপঝাড়ের ফাঁক দিয়ে নেশাগ্রস্তের মতো ঘুরে বেড়াতে লাগল বিনু। কতক্ষণ ঘুরেছিল, মনে নেই। একসময় কার ডাক কানে ভেসে এল।
চমকে সামনের দিকে তাকাল বিনু, কাউকে দেখতে পেল না।
আবার ডাকটা শোনা গেল, ছুটোবাবু—ছুটোবাবু—
এদিকে সেদিকে তাকাতে তাকাতে এবার বিনুর চোখে পড়ল। পচা পাটের স্তূপের ভেতর সেই লোকটা বসে আছে। তোক না বলে তাকে ছোকরা বলাই উচিত।
ফিটনে করে আসার সময় ওইখানেই দু’জনকে কী করতে দেখেছিল বিনু, পরে টানাটানি করে তাদের মালপত্র নামাতে দেখেছে, নামও জেনেছে। একজনের নাম যুগল, অন্য জনের নাম করিম। তবে কে যুগল কে করিম, জানা যায় নি।
যুগল হোক করিম হোক, এখন একজনই বসে বসে পচা পাটের গা থেকে আঁশ ছাড়াচ্ছে। আরেকজনকে দেখা গেল না।