ঠিক।
অবনীমোহন বললেন, এখন কোথায় যাবেন মামাবাবু?
হেমনাথ জানালেন, কেতুগঞ্জ।
অবনীমোহন আর কোনও প্রশ্ন করলেন না। মুখচোখ দেখে মনে হল, হেমনাথের কেতুগঞ্জ যাবার ব্যাপারে তার কৌতূহল আছে, হয়তো কিছু প্রশ্নও।
অবনীমোহনের মনের কথা বুঝিবা পড়তে পারলেন হেমনাথ। বললেন, কেতুগঞ্জের মজিদ মিঞা আমার ছোট ভাইয়ের মতো। এক কানি জমি নিয়ে ওর সঙ্গে চরবেহুলার নবু গাজীর দাঙ্গা হয়ে গেছে। দু’পক্ষে আট দশজন জখম হয়ে সদর হাসপাতালে পড়ে আছে। নবু গাজীর সঙ্গে যাতে মজিদের একটা মীমাংসা হয়, সে জন্যে আমি চেষ্টা করছিলাম। আচ্ছা, পরে এসে তোমাকে সব বলব।
হেমনাথ সেই মুসলমান মাঝি দুটির সঙ্গে চলে গেলেন।
অবনীমোহন বললেন, মামাবাবু তো বেশ ঝঞ্ঝাট পোয়াতে পারেন!
ওধার থেকে স্নেহলতা বললেন, এই একটা ঝঞ্জাট নাকি? সবে এসেছ। কদিন থাকলেই দেখতে পাবে কত ঝামেলা মাথায় নিয়ে বসে আছে তোমার মামাবাবু। রাত নেই, দিন নেই, এ আসছে ডাকতে, ও আসছে। এক দণ্ড যদি ঘরে স্থির হয়ে বসে!
বিনু কিছুই বোধহয় শুনতে পাচ্ছিল না। একদৃষ্টে পুকুরঘাটের দিকে তাকিয়ে ছিল। এতক্ষণে নৌকোটা ছেড়ে দিয়েছে, দেখতে দেখতে পুকুর পেরিয়ে ধানবনের কাছাকাছি চলে গেল সেটা।
বিনুর খুব ইচ্ছে হচ্ছিল, ভাসতে ভাসতে দাদুর সঙ্গে কেতুগঞ্জে যায়, আগে আর কখনও নৌকোয় চড়ে নি সে।
১.০৩ হেমনাথের নৌকো
হেমনাথের নৌকো ধানবনের ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেলে স্নেহলতা বললেন, ঘরে এস মানিকেরা– বলে পা বাড়িয়ে দিলেন।
স্নেহলতার পিছু পিছু সবাই সামনের পুবদুয়ারী বড় ঘরখানায় এল। ঘাড় ফিরিয়ে বিনু একবার দেখে নিল, হিরণ যুগল আর করিম ফিটন থেকে মালপত্র নামিয়ে ওদিকের একটা ঘরে নিয়ে রাখছে।
স্নেহলতার গলা আবার শোনা গেল, এখন আর কোনও কথা না, উঠোনে জল দেওয়া আছে। হাত-পা ধুয়ে আগে কিছু খেয়ে নাও। ধনেদের মুখ খিদেয় একবারে শুকিয়ে গেছে।
খানিক আগে আরেক বার ধন’ বলেছিলেন স্নেহলতা, এবারও বললেন। কথায় কথায় ওই শব্দটা বলা বোধহয় তার অভ্যাস। ফিক করে এবারও বিনু হেসে ফেলল।
হাসিটা কানে গিয়েছিল। স্নেহলতা শুধোলেন, হাসলি যে দাদা?
বিনু লজ্জা পেয়ে চোখ সরিয়ে নিল।
সুরমা ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিলেন। হাসতে হাসতে বললেন, তুমি ধন’ বলেছ মামী, সেই জন্যে।
স্নেহলতা সস্নেহে হাসলেন। বললেন, শুধু ধন নাকি, আরও কত কি বলি দেখ না। তখন কত হাসতে পার, দেখব।
একটু পর হাত মুখ ধুয়ে এসে সবাই খেতে বসল। অবনীমোহন সুধা সুনীতি বিনু এবং সেই পুতুল পুতুল মেয়েটা–ঝিনুক। ফিটন থেকে বাক্স-টাক্স নামানো হয়ে গিয়েছিল। হিরণকে ডেকে এনে বসিয়ে দিলেন স্নেহলতা। সুরমা অবশ্য বসলেন না।
অবনীমোহন স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, সকাল থেকে কিছুই তো খাওনি, তুমিও বসে পড়।
কলকাতায় স্বামী এবং ছেলেমেয়েদের সঙ্গে খেতে বসে যান সুরমা। খাবার দাবার মাঝখানে সাজানো থাকে। দরকারমতো সবাই চামচে করে তুলে নেয়। কলকাতার রীতি আলাদা। কিন্তু এখানে কেউ কিছু ভাবতে পারে। কলকাতা থেকে অনেক দূরে এই ছোট্ট রক্ষণশীল জগতে স্বামীর সঙ্গে খেতে বসা নিন্দনীয়।
অবনীমোহন যে এভাবে ডেকে বসবেন, সুরমার পক্ষে তা ছিল অভাবনীয়। তিনি লজ্জা পেয়ে গেলেন।
স্নেহলতাও বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, তুই বসে পড়।
মৃদু স্বরে সুরমা বললেন, আমি পরে খাব’খন।
অবনীমোহন ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, পরে টরে না। অসুস্থ শরীর, ডাক্তার না তোমায় বলে দিয়েছে। সকালবেলা সাতটার ভেতর খেয়ে নিতে। অনিয়ম করলে–
বিব্রত সুরমা চাপা গলায় ধমক দিলেন, আমার জন্যে ভাবতে হবে না। তুমি খেয়ে নাও তো।
অবনীমোহন আর কিছু বললেন না।
স্নেহলতা এবং শিবানী ফুলকাটা কঁসার থালায় পাতলা চিঁড়ে কদমা গুড় আর পাতক্ষীর সাজিয়ে সবাইকে দিতে লাগলেন। বড় বড় জামবাটি ভর্তি করে ঘন আঠালো দুধও দিলেন।
খেতে খেতে হঠাৎ হিরণ বলল, কি ঠাকুমা, ঠকাবার মতলব নাকি?
জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন স্নেহলতা, ঠকাব!
হুঁ– হিরণ ঘাড় কাত করল, গাড়ি থেকে রসগোল্লার হাঁড়ি আর কলার কাদি নামিয়ে তোমার হাতে দিলাম না? সে সব কোথায়?
তাই তো– তাড়াতাড়ি জিভ কেটে স্নেহলতা উঠে পড়লেন। ছুটে গিয়ে ওধারের কোনও একটা ঘর থেকে রসগোল্লা আর কলা নিয়ে এসে সবার পাতে পাতে দিতে লাগলেন।
বড়দের চারটে করে রসগোল্লা আর দু’টো করে কলা দিয়েছেন স্নেহলতা। বিনুকে দিয়েছেন দুটো রসগোল্লা আর একটা কলা, ঝিনুকের ভাগে পড়েছে আরও কম–কলা আধখানা, রসগোল্লা একটা।
বিনুর ঠিক পাশেই ঝিনুক খেতে বসেছিল। আড়ে আড়ে একবার বিনুর পাতের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ হাত-পা ছুঁড়তে শুরু করল সে, আমি আধখানা কলা খাব না, একটা রসগোল্লা খাব না।
স্নেহলতা শুধোলেন, ক’টা খাবি?
গোটা কলা খাব, দুটো রসগোল্লা খাব–
তোর পেট ভাল না ঝিনুক, সহ্য করতে পারবি না। নিজেও কষ্ট পাবি, আমাকেও জ্বালিয়ে মারবি।
হাত-পা ছোঁড়া থামায় নি ঝিনুক। মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে সে বলতে লাগল, ওকে কেন দিলে তা হলে? কেন দিলে ওকে?
স্নেহলতা অবাক, কাকে রে, কাকে?
আঙুল দিয়ে বিনুকে দেখিয়ে দিল ঝিনুক, ওকে।
পেট ভর্তি তোমার বিষ, ছেলেটা বাড়ি ঢুকতে না ঢুকতেই হিংসে আরম্ভ করে দিয়েছ!
সুরমা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন। হাসতে হাসতে বললেন, দাও মামী, ঝিনুক যা চাইছে দাও–