বর্ষীয়সী সধবা মহিলাটির গা ঘেঁষে একজন বিধবা দাঁড়িয়ে, দু’জনে সমবয়সিনীই হবেন। বিধবাটির চুল ছোট ছোট করে ছাঁটা, পরনে ধবধবে সাদা থান আর সেমিজ। চেহারায় হেমনাথের পুরো আদলটিবসানো। খুব সম্ভব তার বোন টোন।
সধবা আর বিধবা এই দুই সমবয়সিনীর পেছনে যারা ভিড় করে দাঁড়িয়ে, এক পলক তাকিয়েই অনুমান করা যায়, তারা এ বাড়ির আশ্রিত। হয়তো হেমনাথের সংসারে কাজকর্ম করে তাদের দিন চলে।
ফিটন থামতে প্রথমেই ঝিনুককে নিয়ে হেমনাথ নামলেন। মহিলা দুটির দিকে ফিরে উচ্ছ্বসিত সুরে বললেন, দেখ, কাদের এনেছি।
মহিলারা আরেকটু এগিয়ে এলেন। ততক্ষণে অবনীমোহন বিনু আর সুরমা নেমে পড়েছেন। সুরমা তাড়াতাড়ি ঝুঁকে মহিলা দুটিকে প্রণাম করলেন। বললেন, কেমন আছ মামী? কেমন আছ মাসি? কপালে সিঁদুর, পরনে লালপাড় শাড়ি মহিলাটি হেমনাথের স্ত্রী স্নেহলতা। বিধবা মহিলাটি তার বোন। নাম–শিবানী।
শিবানী আর স্নেহলতা দু’জনে চিবুক ছুঁয়ে সুরমাকে চুমু খেলেন। হেমনাথ যা বলেছিলেন এরাও তাই বললেন, আমরা তো ভালই আছি। কিন্তু তোর শরীরের একি হাল হয়েছে মা!
সুরমা হাসলেন, শরীরের কথা থাক। সব সময় ওই এ কী কথা শুনছি।
সুরমার পর অবনীমোহন আর বিনু গিয়ে প্রণাম করল। হেমনাথ তাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন।
স্নেহলতা স্বামীর দিকে এক পলক তাকিয়ে নিয়ে আস্তে করে ঝঙ্কার দিলেন, থাক, আর বলে দিতে হবে না। আমার জামাই, আমার নাতিকে যেন চিনতে পারি নি?
বিনুদের ফিটনের ঠিক পেছনেই সুধাদের ফিটনটা থেমেছিল। সুরমা গলা তুলে ডাকলেন, কি রে সুধা সুনীতি, তোরা দেখি গাড়িতেই বসে রইলি!
ডাকাডাকিতে সুধারা নামল। দেখা গেল, সুধা আর হিরণ খুব কথা বলছে। আর সুনীতি মুখ টিপে টিপে হাসছে। তিনজনের ভেতর হয়তো কোনও মজার আলোচনা চলছে।
হেমনাথ ভাবছিলেন, কাঠের পুলটা থেকে এ বাড়ি এক মাইলের মতো। ফিটন ছুটিয়ে আসতে কতক্ষণ আর লেগেছে! খুব বেশি হলে মিনিট দশ বার। কিন্তু এর ভেতরেই সুধা আর হিরণ কেমন আলাপ জমিয়ে নিয়েছে।
হেমনাথ সুধাকে বললেন, পড়েছিস তো হিরণের পাল্লায়। কী কথাটাই না বলতে পারে! সবসময় বকবকায়মান।
সুরমা বললেন, হিরণের দোষ দিচ্ছ মামা! তোমার ছোট নাতনীকে তো এখনও চেন নি। দিনরাত খালি কথা আর কথা। একটা কিছু পেল তো একেবারে কলের গান চলল, থামে আর না। ওর বকবকানিতে কানের পোকা নড়ে যায়।
হেমনাথ বললেন, ভালই হল। দু’টোর মিলবে বেশ।
কিছু না ভেবেই শেষ কথাগুলো বলেছেন হেমনাথ, তবু চকিতে হিরণ আর সুধা পরস্পরের দিকে একবার তাকাল, তারপর মুখ ফিরিয়ে নিঃশব্দে হাসল।
সুরমা বললেন, যাও, দিদাদের প্রণাম কর।
সুধা সুনীতি এগিয়ে গিয়ে স্নেহলতা আর শিবানীকে প্রণাম করল। তারা উঠে দাঁড়ালে সকৌতুক দৃষ্টিতে স্ত্রীকে বিদ্ধ করে হেমনাথ সহাস্যে বললেন, কিরকম দেখলে গিন্নী?
স্নেহলতা বুঝতে পারেন নি। বললেন, কী?
সুধা সুনীতিকে—
দু’জনেই সুধা।
তোমার কপাল কিন্তু পুড়ল।
ইঙ্গিতটা এবার বুঝতে পারলেন স্নেহলতা। হাসিমুখে বললেন, ভয় দেখাচ্ছ?
তুমিই বিবেচনা কর। হেমনাথ বললেন, ভাবছি তোমাকে বিদেয় করে এবার এই দু’জনকে রাজমহিষী করে নেব।
বিদেয় করবে কি? তার আগে আমিই পালিয়ে যাব। বলে বিনুর চোখে চোখ রাখলেন স্নেহলতা, কি দাদা, সুভদ্রাহরণ করতে পারবে তো?
ঠিক এই সময় হিরণ চেঁচিয়ে উঠল, অ্যাইও–
কী হল রে? চমকে স্নেহলতা তাকালেন।
আমার সঙ্গে পালাবার প্ল্যান করেছিলে না সেদিন? আবার এর ভেতরে বিনুকে জুটিয়ে ফেললে?
সবাই হেসে উঠল।
হাসি থামলে শিবানী বললেন, আর উঠোনে না, ঘরে চল সব।
স্নেহলতা সস্নেহে ডাকলেন, এস ধনেরা, এস—
‘ধন’ বলে সম্বোধন করতে আগে আর কারোকে শোনে নি বিনু। ফিক করে হেসে ফেলল সে।
হেমনাথ সেই কামলা দুটোকে বললেন, যুগল করিম, গাড়ি থেকে মালপত্র নামিয়ে আন–
কামলা দু’জনের নাম জানা গেল। তবে কে যুগল আর কে করিম, বুঝতে পারল না বিনু।
স্নেহলতা সবাইকে নিয়ে ভেতর-বাড়ির দিকে যাচ্ছিলেন। দু’চার পা এগিয়েছিলেন, দুটো লোক প্রায় ছুটতে ছুটতে উঠোনে এসে পড়ল। হাঁপাতে হাঁপাতে ডাকল, বড়কত্তা
সবাই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। যে লোক দুটি ছুটে এসেছে তারা মধ্যবয়সী চাষী কি মাঝি শ্রেণীর মানুষ।
হেমনাথ বললেন, কী ব্যাপার রে?
দু’জনেই প্রায় একসঙ্গে বলল, মজিদ ভাই অহনই আপনেরে যাইতে কইছে। আমরা নাও লইয়া আইছি। চলেন–
কেন, কিছু জানিস?
চরবেউলা থিকা নবু গাজী আইছে যে।
হেমনাথ অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, যাব। এখনই যেতে হবে। নৌকো কোথায় রেখেছিস?
আপনের পুকৈর ঘাটে।
পুকুরটা এখান থেকে বেশ খানিকটা দূরে, বাগানের ওধারে তবু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। ভিড়ে ভেতর থেকে মুখ বাড়িয়ে টুক করে একবার দেখে নিল বিনু। সত্যিই একটা ছইওলা নৌকো সেখানে বাঁধা আছে, হাওয়ায় অল্প অল্প দুলছে।
হেমনাথ এবার এদিকে ফিরে বললেন, রমু অবনী, আমাকে একবার বেরুতে হচ্ছে। তোমরা বিশ্রাম করে খাওয়াদাওয়া সেরে নিও, আমার জন্যে বসে থেকো না। হিরণকে বললেন, তুই এখন আর বাড়ি যাস না, আমাদের এখানেই খাবি। কিছু দরকার টরকার হলে-বুঝলি না, আমি তো বাড়িতে থাকব না–
হিরণ বলল, বুঝেছি। গৃহস্বামীর অনুপস্থিতিতে তার দায়িত্বগুলো আমার ঘাড়ে চাপল, এই তো?