সুরমা বললেন, ওর কথা তো তুমি আগেই বলেছ।
কতটুকু আর বলেছি! আমার বন্ধু দ্বারিক দত্তর নাতি তো?
হ্যাঁ।
ও তো সামান্য পরিচয়। হিরণ গেল বার ইকনমিকস অনার্সে ফার্স্ট ক্লাস সেকেণ্ড হয়েছে। এবছর এম. এ ফিফথ ইয়ার। হেমনাথের বলার ভঙ্গিতে গর্ব যেন মাখানো।
সুরমা আর অবনীমোহন সস্নেহে তাকিয়ে ছিলেন। এবার তাদের দৃষ্টিতে স্নেহের সঙ্গে আর কিছু মিশল। সুরমা বললেন, বাঃ বাঃ, এ তো গৌরবের কথা।
প্রশংসার কথায় মুখ লাল হয়ে উঠেছিল হিরণের। চোখ নামিয়ে লাজুক সুরে সে বলল, গৌরব টৌরব আবার কি।
হেমনাথ বললেন, হিরণচন্দরের সব চাইতে বড় পরিচয় যেটা তা হল ও আমার ফ্রেণ্ড, ফিলজফার অ্যাণ্ড মিসগাইড।
হিরণ চেঁচামেচি করে উঠল, আমি তোমার মিসগাইড দাদু! এভাবে আমার দুর্নাম রটিয়ে বেড়াচ্ছ!
আরও কত কি রটিয়ে বেড়াই একবার দ্যাখ না।
হিরণ কী বলতে যাচ্ছিল, হাতের ইঙ্গিতে তাকে থামালেন হেমনাথ। হাসতে হাসতে বললেন, ঝগড়াঝাটি পরে হবে। দুদিন দু’রাত জার্নি করে ওরা এসেছে, খুব ক্লান্ত। এখন বাড়ি যাওয়া দরকার।
হিরণ ব্যস্ত হয়ে পড়ল, হ্যাঁ, সে তো ঠিকই।
হেমনাথ শুধালেন, তুই কি এখন বাড়ি ফিরবি হিরণ?
যা। ফিটনের ভেতরটা ভাল করে দেখে নিয়ে হেমনাথ বললেন, তাই তো, একটুও জায়গা নেই। তোকে কোথায় বসাই?
আমি হেঁটে যাচ্ছি, তোমরা চলে যাও।
এখান থেকে বাড়ি পাক্কা এক মাইল রাস্তা। হেঁটে যাবি? এই সময় অবনীমোহন বলে উঠলেন, পেছনের ফিটনটায় শুধু সুধা সুনীতি রয়েছে, ওখানে একজনের জায়গা হতে পারে।
হেমনাথ বললেন, তা হলে আমি ঝিনুককে নিয়ে সুধাদের কাছে চলে যাই, হিরণ বরং এখানে বসে যাক।
হেমনাথ হয়তো ভেবেছেন, দুটি তরুণীর সঙ্গে এক ফিটনে অনাত্মীয়, অপরিচিত একজন যুবককে তুলে দেওয়া ঠিক হবে না।
অবনীমোহন তাড়াতাড়ি বললেন, আপনি কেন যাবেন? হিরণই ওই ফিটনে যাক। আমি ওকে দিয়ে আসছি। বলে দরজা খুলে নেমে পড়লেন।
অবনীমোহন মানুষটি চিরদিনই উদার, সংস্কারমুক্ত। ছেলেমেয়েদের তিনি নিজের ছাঁচে গড়ে তুলতে চেয়েছেন। নিজের নিজের সম্মান আর মর্যাদা বাঁচিয়ে তারা মানুষের সঙ্গে মিশুক, এটাই তার কাম্য। চারদিকের দরজা জানালা খুলে দিয়ে বাইরের আলো বাতাস যতখানি পারে ভেতরে নিয়ে আসুক, অবনীমোহন তা-ই চান।
সুধাদের ফিটনটা পেছনে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। অবনীমোহন হিরণকে সেখানে বসিয়ে একটু পর ফিরে এলেন। আবার ফিটন চলতে শুরু করল।
কিছুক্ষণ পর অবনীমোহন বললেন বেশ ছেলে।
হেমনাথ বললেন, কার কথা বলছ? হিরণের?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
বেশ বললে যথেষ্ট বলা হয় না। এমন ছেলে আমাদের রাজদিয়াতে আর একটিও নেই।
রাস্তা যেখানে এসে ফুরিয়ে গেছে, রাজদিয়া শহরের সেটাই বোধ হয় শেষ বাড়ি। তারপর থেকে শুরু হয়েছে মাঠ। এই আশ্বিনে মাঠ না বলে তাকে সমুদ্র বলাই উচিত। অনেক, অনেক দূরে আকাশ যেখানে ধনুরেখায় দিগন্তে নেমে গেছে ততদূর পর্যন্ত গাছপালা, ঘরবাড়ি, মানুষের বসতি, এমন কি এক টুকরো মাটির চিহ্নও নেই। শুধু জল আর জল। অথৈ, অগাধ জল। তার ওপর মেঘের মত ধানবন মাথা তুলে আছে।
বাড়িটা অনেকখানি জায়গা জুড়ে, প্রায় সাত আট বিঘের মতো হবে। চারদিক ঘিরে পাঁচিল অবশ্য নেই। সামনের দিকে এক ধারে প্রকাণ্ড বাগান। সেখানে সবই চেনাজানা গাছের ভিড়। আম জাম লিচু জামরুল কাঁঠাল। আর রয়েছে দেশি ফুলেরা সন্ধ্যামালতী টগর গন্ধরাজ কঁঠালি চাপা। বাগানটা ঘন ছায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে।
একদিকে বাগান, আরেক দিকে দীঘির মতো বিশাল পুকুর। পুকুরটার আলাদা কোনও অস্তিত্ব এই মুহূর্তে নেই। মাঠের জলের সঙ্গে সেটা এখন একাকার।
রাস্তা পেছনে ফেলে ফিটন বাগানে ঢুকল। একধারে দুটি অল্পবয়সী কামলা স্থূপীকৃত পচা পাট থেকে শোলা আর আঁশ বার করে করে রাখছিল। পচা পাটের দুর্গন্ধে চারদিকের বাতাস আড়ষ্ট হয়ে রয়েছে।
ফিটন দেখে কামলা দু’টো বিদ্যুৎগতিতে উঠে দাঁড়াল। গলা ফাটিয়ে চেঁচাল, আইস্যা গ্যাছে, আইস্যা গ্যাছে– বলেই উধ্বশ্বাসে ভেতরের দিকে ছুটল।
বাগান পেরিয়ে মস্ত উঠোন। কামলারা ভেতরে পৌঁছবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ফিটন উঠোনে এসে থামল।
উঠোনের একধারে রাসমঞ্চ, দোলমঞ্চ, তুলসীমঞ্চ। আরেক ধারে পর পর অনেকগুলো খড়ের পালা সাজানো। তিন দিক ঘিরে সারি সারি ঘর। পুরোপুরি পাকা বাড়ি নয়। মেঝে সিমেন্টের, ওপরে নকশা-করা টিনের চাল, কাঠের দেওয়ালে বড় বড় জানালা ফোঁটানো।
ফিটন দুটো থেমেছে কি থামে নি, সারা বাড়িতে হইচই শুরু হয়ে গেল। সেই কামলা দু’টো তো চেঁচাচ্ছিলই, ভেতর থেকে আরও কয়েকজন প্রায় ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে এল। সবাই মহিলা আর শিশু। বয়স্ক পুরুষ কিংবা যুবক তাদের ভেতর নেই।
একবারে সামনে যিনি তাঁর বয়স পঞ্চাশোর্ধ্বে। শ্যামাঙ্গীই বলা যায়। নাক মুখ তেমন ধারাল নয়, তবে চুল অজস্র। এর মধ্যেই স্নান সেরে নিয়েছেন, পিঠময় কাঁচাপাকা ভিজে চুল ছড়ানো, প্রান্তে একটি গিট বাঁধা। কপালে তামার পয়সার আকারে সিঁদুরের মস্ত টিপ, সিঁথিও ডগডগে। পরনে লাল নকশা-পাড় শাড়ি আর সাদা জামা। ঠোঁট দুটি টিয়াপাখির ঠোঁটের মতো পানের রসে টুকটুকে।
আলাদা আলাদা করে দেখলে হাত-পা-নাক-চোখ তেমন কিছু নয়। তবে সব মিলিয়ে মহিলাকে ঘিরে কোথায় যেন অলৌকিকের ছোঁয়া আছে।