- বইয়ের নামঃ কেয়াপাতার নৌকো
- লেখকের নামঃ প্রফুল্ল রায়
- প্রকাশনাঃ করুণা প্রকাশনী (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১.০১ ভাল করে সকাল হয় নি
কেয়াপাতার নৌকো – প্রফুল্ল রায়
অখণ্ড সংস্করণ । তিন পর্বে সম্পূর্ণ
প্রসঙ্গত
যতদূর মনে পড়ে, ষাটের দশকে প্রখ্যাত কথাশিল্পী নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় গোল পার্কের কাছে পঞ্চাননতলায় নতুন বাড়ি কিনে চলে আসেন। আমার লেখালেখির শুরু থেকেই তার সঙ্গে পরিচয়। তিনি এবং তার স্ত্রী আশা বৌদি অপার স্নেহে আমাকে কাছে টেনে নিয়েছিলেন।
আমি দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা। নারায়ণদা পঞ্চাননতলায় চলে আসায় যোগাযোগের অনেক সুবিধা হল। ছুটির দিনে প্রায়ই তাদের বাড়ি চলে যেতাম। একদিন কথায় কথায় দেশভাগের প্রসঙ্গ উঠল। বাংলা সাহিত্যের কীর্তিমান লেখকদের অনেকেই তখন জীবিত। কিন্তু দাঙ্গা ও দেশভাগের মতো বাঙালি জীবনের এমন ভয়াবহ বিপর্যয় তাদের লেখায় কেন যে ব্যাপকভাবে দেখা যায়নি তা নিয়ে আমার যথেষ্ট আক্ষেপ ছিল। নারায়ণদা পূর্ব বাংলার মানুষ। তার দু’চারটি ছোট গল্প এবং উপন্যাসে দাঙ্গা ও দেশভাগের কিছু চিত্র অবশ্যই আছে। তাকে বড় আকারে এই বিষয়ে একটি উপন্যাস লেখার আর্জি জানিয়েছিলাম। নারায়ণদা বলেছেন, অনেক কাল আগে দেশ ছেড়ে চলে এসেছেন। পূর্ব বাংলা তার স্মৃতিতে যতটা আছে, অনুভূতিতে ততটা নেই। তিনিই বরং আমাকে এ বিষয়ে লিখতে বলেন। কেননা দেশভাগের কারণে জন্মভূমি থেকে আমাকে উৎখাত হয়ে চলে আসতে হয়। দেশ হারানোর সেই যন্ত্রণা আমি চিরকাল ভোগ করে চলেছি।
নারায়ণদা’র কথায় কয়েক মাস পর লেখাটা শুরু করি। নামকরণ হয় ‘কেয়াপাতার নৌকো’। সেই সময় সাপ্তাহিক ‘অমৃত’ পত্রিকার কার্যনির্বাহী সম্পাদক ছিলেন কবি মণীন্দ্র রায়। কিভাবে জানতে পেরে উপন্যাসটা দ্রুত শেষ করে পান্ডুলিপি তাকে দেবার জন্য তাগাদা দিতে থাকেন। ‘অমৃত’-এ ধারাবাহিকভাবে ১৯৬৮-৬৯ সালে এটি প্রকাশিত হয়। নারায়ণদা এবং মণিদা দুজনেই প্রয়াত। এই উপন্যাস লেখার প্রেরণা দান এবং প্রকাশের জন্য শ্রদ্ধেয় দুই অগ্রজকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই।
দীর্ঘ বত্রিশ বছর পর দৈনিক বর্তমান পত্রিকার সাহিত্য বিভাগের সম্পাদক কাকলি চক্রবর্তী এবং তার সহকারী সাহানা নাগচৌধুরীর অফুরান আগ্রহ ও তাগিদে ২০০১ ও ২০০২ সালের শারদীয় ‘বর্তমান’ পত্রিকায় ‘কেয়াপাতার নৌকো’র শেষ পর্বটি লিখি। পর পর দু’বছরে তৃতীয় এবং চতুর্থ পর্ব হিসেবে প্রকাশিত হলেও আসলে এটি তৃতীয় পর্ব। এবং শেষ পর্বও। দুই অংশের প্রকাশকালের মধ্যে ছিল এক বছরের ব্যবধান। পাঠক যাতে সেই হারিয়ে না ফেলেন সেজন্য এটিকে তৃতীয় ও চতুর্থ পর্ব, এভাবে ভাগ করা হয়েছিল।
তিন পর্বে সম্পূর্ণ ‘কেয়া পাতার নৌকো’র অখণ্ড সংস্করণ এ বছর বইমেলায় প্রকাশিত হল।
প্রসঙ্গত জানাই, এই গ্রন্থের পরবর্তী আরও দু’তিনটি খণ্ড লেখার পরিকল্পনা আছে। সেগুলি প্রকাশিত হবে ভিন্ন ভিন্ন নামে। প্রধান কিছু চরিত্র একই থাকবে। তাদের সঙ্গে যুক্ত হবে আরও অসংখ্য মানুষ। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়া ছিন্নমূল জনগোষ্ঠীর অনন্ত জীবনযুদ্ধের কাহিনী এই উপন্যাসগুলিতে ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করব। সেগুলির পটভূমি হবে বিশাল। দেশভাগের পরবর্তী অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে বাঙালির সামাজিক, পারিবারিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক জীবনে যে মহা সংকট ঘনিয়ে এসেছে তার চিত্র কতটা ধরতে পারব, জানি না। কারণ আমার বয়স সত্তর ছুঁই ছুঁই। যদি আরও কয়েক বছর কর্মক্ষম থাকি, এই কাজটি শেষ করতে চাই। যদি তা সম্ভব হয়, আমার লেখক জীবনের বৃত্ত মোটামুটি সম্পূর্ণ হবে।
গ্রন্থকার
.
প্রথম পর্ব
১.০১
ভাল করে সকাল হয় নি এখনও। স্টিমারের গতি হঠাৎ মন্থর হয়ে এল।
উনিশ শ’চল্লিশের অক্টোবর। বার বছরের বিনু বাংলা মাস আর সালও জানে। আশ্বিন, তের শ’ সাতচল্লিশ।
এত ভোরে রোদ ওঠে নি। উত্তর-দক্ষিণ-পশ্চিম, তিন দিক আবছা অন্ধকারে মলিন। তার ওপর পাতলা নরম সিল্কের মতো কুয়াশা। শুধু পুব দিকটায় আলো আলো একটু আভা ফুটেছে। বাতাস বইছে উত্তর থেকে দক্ষিণে, কখনও পুবে-পশ্চিমে আড়াআড়ি। শরতের বাতাস–এলোমেলো, ঝিরঝিরে, সুখদায়ক। তার গায়ে হিমের আমেজ মাখানো।
মস্ত জলপোকার মতো স্টিমারটা এতক্ষণ যেন হাত-পা ছুঁড়ে এলোপাতাড়ি সাঁতার কাটছিল, এখন গা ভাসিয়ে দিয়েছে।
গতি কমে এসেছিল, ইঞ্জিনের ধকধকানিও ক্রমশ স্তিমিত হয়ে যাচ্ছে। দু’ধারের বড় বড় চাকা দু’টো আগের মতো গর্জন করে জল কাটছে না, আলতোভাবে নদীকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে ঘুরে যাচ্ছে।
এই ভোরবেলাতেই ঝাঁকে ঝাঁকে শঙ্খচিল বেরিয়ে পড়েছে। গলায় সাদা বর্ডার দেওয়া খয়েরি রঙের পাখিগুলো স্টিমারটাকে ঘিরে সমানে চক্কর দিচ্ছে। তাদের চোখ কিন্তু জলের দিকে। মাছের রুপোলি শরীর দেখতে পেলেই হয়, সঙ্গে সঙ্গে ছোঁ দিয়ে পড়ছে। মুহূর্তে বাঁকানো ঠোঁটে শিকার বিধিয়ে উঠে আসছে। আর বকেরা? তাদেরও ধ্যান-জ্ঞান মাছেরই দিকে।
জলের ধার ঘেঁষে ডেকের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে ছিল বিনু। একপাশে তার বাবা অবনীমোহন, আরেক পাশে দুই দিদি-সুধা আর সুনীতি। মা আসেন নি, এত ভোরে ওঠা তাঁর বারণ। চিরদিনই মা অসুস্থ, রুগ্ণ। ভোরের ঠাণ্ডা জলো হাওয়া লাগালে শরীর আরও খারাপ হবে, তাই কেবিনে শুয়ে আছেন।