এদিকে বিশ্বজিৎ রাহা বিনয়ের কাছে চলে এসেছিলেন। বললেন, ‘চলুন, আমার সঙ্গে গাড়িতে যাবেন।‘
অন্য সব গাড়ি চলে গেলেও একটিমাত্র জিপ রাস্তার একধারে দাঁড়িয়ে ছিল। বিশ্বজিৎ সেদিকে পা বাড়াতে যাবেন, হঠাৎ বিনয়ের মনে পড়ল, হলধরদের কথা দেওয়া হয়েছে আন্দামানে সে যতদিন। আছে তাদের সঙ্গে থাকবে। অঙ্গীকার তো ভাঙা যায় না। অবশ্য এটাও ঠিক, আন্দামানের নানা জায়গা তাকে যেতে হবে। সারাটা। সফর ওদের সঙ্গে কাটানো সম্ভব নয়। কিন্তু প্রথম দিকের বেশ কয়েকটা দিন ওদের কাছে থাকতেই হবে।
বিনয় বলল, ‘কিছু মনে করবেন না। আমি ওদের সঙ্গেই যেতে চাই’ কেন যাওয়া দরকার সেটা বুঝিয়ে বলল।
বুঝেছি, অজানা নতুন জায়গায় ওরা আপনার ওপর খুব ডিপেন্ড করছে। বিশ্বজিৎ একটু হেসে বললেন, ‘চলুন, আমিও হাঁটতে হাঁটতে যাই। এবারডিন বাজারের সামনের মাঠে আমাকেও যেতে হবে। রাত্তিরে রিফিউজিদের খাওয়া-থাকার কী ব্যবস্থা হয়েছে, কোথাও কোনও ত্রুটি আছে কিনা সেসব দেখে রাত্তিরে আমার বাংলোয় ফিরব।’ তার জিপের ড্রাইভার কালীপদকে–রোগা, কালো, লম্বাটে মুখ, ঝাকড়া চুল, বছর পঁচিশ বয়স- ডেকে জিপ নিয়ে এবারডিন বাজারে চলে যেতে বললেন।
এদিকে উদ্বাস্তুদের দলটা সারি দিয়ে চলতে শুরু করেছে। দক্ষ গাইডের মতো বিভাস আর নিরঞ্জন তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
সমুদ্রের ধার ঘেঁষে যে রাস্তাটা ডাইনে এবং বয়ে গেছে সেটা ধরে নয়; যে রাস্তাটা সোজা টিলার পর টিলা পেরিয়ে ওপরে উঠেছে সেটা দিয়েই এগিয়ে চলেছে সবাই। মাঝখানে একটু দুরত্ব রেখে বিশ্বজিৎ আর বিনয় উদ্বাস্তুদের পাশাপাশি হাঁটছিল।
‘রস’ আইল্যান্ডে নিরঞ্জন পরিচয় করিয়ে দেবার সময় বিনয় আন্দাজ করেছিল বিশ্বজিতের বয়স-বত্রিশ তেত্রিশ হবে। অর্থাৎ তার চেয়ে মোটামুটি বছর দশেকের বড়। সতেজ, মেদহীন চেহারা। পরিপূর্ণ যুবকই বলা যায় তাঁকে।
কম বয়সে বিরাট সরকারি দায়িত্ব পেলে প্রায় সবারই একটা ভারিক্কি ভাব এসে যায়। সারাক্ষণ গম্ভীর। চারপাশে উঁচু উঁচু দেওয়াল তুলে তার ভেতর ঢুকে যায় তারা। বুঝিয়ে দেয় তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে। বিশ্বজিৎ কিন্তু তেমনটা নন। হাসিখুশি, কোনও রকম চাতুরি নেই, মৰ্জা করতে পারেন, প্রাণ খুলে হাসতে পারেন। আলাপ হবার সঙ্গে সঙ্গে তাকে ভীষণ ভালো লেগে গিয়েছিল বিনয়ের। আন্দামানে একজন চমৎকার বন্ধু পাওয়া গেছে।
হাঁটতে হাঁটতে কথাও হচ্ছিল। বিশ্বজিৎ বলছিলেন, তখন রিডিউজিদের নিয়ে এমন ব্যস্ত ছিলাম যে ভালো করে আলাপটাই হয়নি। জগদীশকাকা লিখেছেন, আপনাকে যেন সাহায্য করি। ব্যস, এটুকুই। একটু থেমে ফের বলেন, ‘আপনিই প্রথম একজন জার্নালিস্ট যিনি আন্দামানে রিফিউজি সেটেলমেন্ট কভার করতে এসেছেন। আপনার সম্বন্ধে খুব জানতে ইচ্ছে করছে।‘
নিজের থেকে বিনয়কে কিছু বলতে হল না। কয়েক মিনিটের ভেতর নানা প্রশ্ন করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তার সম্পর্কে প্রায় সমস্ত কিছু জেনে নিলেন বিশ্বজিৎ। ঝিনুকের ব্যাপারটা বাদেবাকি সবই বলে। গেল বিনয়। এই একটা গোপন দুর্বল জায়গা আছে তার বুকের ভেতর। নিদারুণ কষ্টকরও। ঝিনুকের কথা যারা জানে তারা জানে। নিজের মুখে বিনয় অন্য কারওকে বলতে পারবে না।
বিশ্বজিৎ গভীর আগ্রহে শুনছিলেন। সহানুভূতিতে তার মন ভরে যায়। ভারী গলায় বললেন, আপনি নিজেও তাহলে দেশভাগের একজন ভিকটিম। তাই উদ্বাস্তুদের সম্বন্ধে এত সিমপ্যাথি। সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আন্দামান অব্দি তাদের সঙ্গে চলে এসেছেন।
কথাটা মোটামুটি ঠিকই। আন্দামানে আসার জন্য ব্যগ্র হয়ে ছিল সে। ‘নতুন ভারত’ অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়ায় এখানে আসা সম্ভব হয়েছে। নইলে এত তাড়াতাড়ি আসা সম্ভব হত না। তবে একদিন।
একদিন, দু বছর পরেই হোক বা চার বছর পরে, এই দ্বীপপুঞ্জে আসতই। পূর্ব পাকিস্তান থেকে যে লক্ষ লক্ষ মানুষ চোদ্দোপুরুষের ভিটেমাটি থেকে উৎখাত হয়ে সীমান্তের এপারে চলে এসেছে, তারা কোথায় কীভাবে নতুন করে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে, নাকি ভেঙেচুরে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, সেসব নিজের চোখে দেখতে চায় সে। শিয়ালদা স্টেশনে, কলকাতার চারপাশের কলোনি আর ত্রাণশিবিরগুলোতে দিনের পর দিন গেছে সে। এখন এসেছে আন্দামানে। শোনা যাচ্ছে, ভারতবর্ষের নানা প্রভিন্সে পুনর্বাসনের জন্য শরণার্থীদের পাঠানো হবে। যেখানেই তারা যাক, বিনয় সেখানেই যাবে।
বিশ্বজিৎ বললেন, ‘আমাদের বাড়িও ছিল ওপারে। আনডিভাইডেড বেঙ্গলের মাইমেনসিং ডিস্ট্রিক্টে। তবে আমরা রিফিউজি না, পার্টিশনের অনেক আগেই চলে এসেছিলাম।’
এই মানুষটি সম্পর্কে বিনয়েরও জানার আগ্রহ কম নয়। কিন্তু বিশ্বজিৎ নিজের ব্যাপারে আর একটি কথাও বললেন না। বিনয় যে জিগ্যেস করবে তেমন সাহস হল না। বেশি কৌতূহল দেখালে বিশ্বজিৎ বিরক্ত হতে পারেন। আন্দামানে যখন আসাই হয়েছে, সবই জানা যাবে।
একটু চুপচাপ। দিনের আলো আরও কমে গেছে। রাস্তার দুধারে কত যে। নারকেল গাছ আকাশের দিকে মাথা তুলে আছে! আর আছে। বিশাল বিশাল শিশু, রেন-ট্রি এবং নাম না জানা মহাবৃক্ষের সারি। সেসবের ফাঁকে ফাঁকে অল্প কিছু কাঠের বাড়ি, ক্কচিৎ দু চারটে পাকা দালান।
অগুনতি গাছের ছায়ায় চারপাশ ঢেকে যাচ্ছে। সব কেমন যেন। ঝাপসা ঝাপসা।
ভালো ছিল
এর আগে– অনেক দিন আগে কেয়া পাতার নৌকা পড়ার সৌভাগ্য হয়েছিল, তখন বয়স ছিল কুড়ি একুশ, এখন বাষট্টি , ঠিক তেমনই আগ্রহ নিয়ে উপন্যাসটি শেষ করলাম। কম্পিউটারাইজড প্রিন্টের জন্য কিছু মুদ্রন প্রমাদ থাকলেও ভীষন ভালো লাগলো। প্রফুল্ল রায়ের লেখা খুব ভালো লাগে। তবে শেষটা জানা গেল না।পরনতি কি হল জানার জন্য মনটা উতলা হয়ে থাকলো।