বিনয় অবাক। ‘রস’ আইল্যান্ডে মহারাজা’ জাহাজ থেকে নামার পর জগদীশ গুহঠাকুরতার চিঠি বিশ্বজিৎকে দেবার পর তিনি যে তাকে তার বাংলোতে থাকার কথা বলেছিলেন সেটা তাহলে লক্ষ করেছে হলধর!
বিনয় বলল, ‘হ্যাঁ, বলেছেন তো—’
হাতজোড় করে হলধর বলল, ‘আপনেরে কিলাম আমরা ছাড়ুম না ছুটোবাবু। আপনের ভরসাতেই আন্ধারমানে আইছি। আমাগো লগে আপনেরে জঙ্গল যাইতেই লাগব।নাইলে পুট বিলাস থিকা আমরা এক পাও লডুম (নড়ব) না।’
তার সঙ্গীরা একই কথা বলে। এমনকী মাখনও।
আন্দামানের বিজন অরণ্যে বিনয়ই তাদের একমাত্র অবলম্বন। খড়কুটোর মতো তাকে আঁকড়ে ধরতে চাইছে হলধররা। লহমার জন্য চোখের আড়াল করতে চায় না।
যেখানে যেখানে উদ্বাস্তুদের বসতি গড়ে উঠছে সেইসব এলাকায় যাবার জন্যই বিনয়ের আন্দামনে আসা। বিশ্বজিতের সঙ্গে আলাপ হবার পর ভেবেছিল, দু-একদিন পোর্ট ব্লেয়ারে তার বাংলোয় থাকবে। এখানকার পুনর্বাসন সম্পর্কে তার কাছ থেকে নিশ্চয়ই প্রচুর তথ্য পাওয়া যাবে। কেননা রিহ্যাবিলিটেশনের বেশির ভাগ দায়িত্বই তার। কিন্তু হলধররা তাকে কিছুতেই ছাড়বে না। সে বিশ্বজিতের বাংলোয় গেলে ওদের মনোবল ভেঙে পড়বে। তার ওপর এত মানুষের এত বিশ্বাস তুচ্ছ করার বস্তু নয়।
বিনয় বলল, ‘ঠিক আছে, আপনাদের সঙ্গেই যাব।’
চারপাশের মুখগুলো থেকে উৎকণ্ঠার ছাপ ধীরে ধীরে মুছে যেতে থাকে। হলধররা আর দাঁড়ায় না। ডেকের অন্য প্রান্তে চলে যায়।
এতক্ষণ হলধরদের নিয়ে ব্যস্ত ছিল বিনয়। ওরা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঝিনুকের চিন্তাটা চারপাশ থেকে তার মাথায় ঝাঁপিয়ে পড়ে।
১.২ সেসোস্ট্রেস বে পেরিয়ে
সেসোস্ট্রেস বে পেরিয়ে কোনাকুনি এপারে এলে পোর্ট ব্লেয়ারের গা ঘেঁষে পাশাপাশি দুটো জেটি। দুই স্টিম লঞ্চ সেখানে এসে ভিড়ল। লঞ্চের খালাসি এবং পুনর্বাসন বিভাগের কর্মীদের ব্যস্ততা শুরু হয়ে যায়।
রেলিং-লাগানো কাঠের পাটাতন ফেলে চোখের পলকে ‘রস’ আইল্যান্ডের মতোই এপারের জেটিতে দুই লঞ্চকে জুড়ে দেওয়া হল। এক লঞ্চে এসেছিল বিভাস, অন লঞ্চটায় নিরঞ্জন। তারা হই হই করে উদ্বাস্তুদের নামাতে শুরু করল। মিনিট পনেরোর ভেতর দুই লঞ্চ কঁকা হয়ে গেল। সবার সঙ্গে অফিসাররাও নেমে এসেছেন। বিনয়ও।
জেটি দুটোর পাশ দিয়ে রাস্তা চলে গেছে। একটা সমুদ্রের ধার দিয়ে দিয়ে। অন্যটা উঁচু উঁচু টিলা পেরিয়ে সোজা ওপর দিকে। রাস্তায় জিপ ছাড়াও অনেকগুলো নানা ধরনের মোটর দাঁড়িয়ে আছে। ফিয়েট, হিন্দুস্থান, অষ্টিন ইত্যাদি ইত্যাদি। বিনয় আন্দাজ করে নিল ওগুলো সরকারি অফিসারদের গাড়ি।
সেনসাহেব, মণ্ডলসাহেবরা সেই সকাল থেকে ‘রস’ আইল্যান্ডে কাটিয়ে এসেছেন। সারাদিনের ধকলে ক্লান্তিবোধ করছিলেন। সবার কাছ থেকে আপাতত বিদায় নিয়ে যে যার গাড়িতে উঠে পড়লেন। বিনয়কে বললেন, আপনি তো এখন কিছুদিন আন্দামানে আছেন। পরে আবার দেখা হবে।
অফিসারদের মধ্যে একমাত্র বিশ্বজিৎ রাহাই থেকে গেলেন। আর রইল পুনর্বাসন দপ্তরের কর্মীরা। আজ মেনল্যান্ড থেকে উদ্বাস্তুরা এসেছে ফেলে তো চলে যাওয়া যায় না।
সূর্যটা খানিক আগে আকাশের ঢালে সিনেমার ফ্রিজ শটের মতো আটকে ছিল। এখন আর সেটাকে দেখা যাচ্ছে না। পশ্চিম দিকের উঁচু পাহাড়ের আড়ালে নেমে গেছে। বাসি হলুদের মতো দিনের শেষ ম্যাড়ম্যাড়ে আলো এখনও জঙ্গলে পাহাড়ে এবং উপসাগরে আলতো ভাবে আটকে আছে। বড়জোর আর মিনিট পনেরো; তারপর সেটুকুও থাকবে না। ঝপ করে সন্ধে নেমে যাবে।
উদ্বাস্তুদের জন্য নতুন নতুন বসতির যে পত্তন হচ্ছে সেগুলো পোর্ট ব্লেয়ার থেকে তিরিশ-চল্লিশ কি পঞ্চাশ মাইল দূরে। আজ সকালে চারদিন বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে তারা ‘রস’ আইল্যান্ডে পৌঁছেছে। একটানা সমুদ্রযাত্রার কারণে তাদের সবার শরীর জুড়ে অপার ক্লান্তি। মুখচোখ দেখে টের পাওয়া যায় হাত-পা যেন ভেঙে আসছে। এই অবস্থায় কি ওদের সুদুর জঙ্গলে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে? উদ্বাস্তুদের এই দঙ্গলে শক্তপোক্ত যুবক যুবতী ছাড়াও রয়েছে বাচ্চাকাচ্চা এবং হাড়ের ওপর চামড়াজড়ানো শীর্ণ থুথুড়ে বুড়োবুড়িরা। পাহাড়ি রাস্তায় টাল খেতে খেতে নতুন বসতিতে পৌঁছতে কত রাত হয়ে যাবে, কে জানে। সেই ধাক্কা কি বয়স্ক মানুষগুলো আর বাচ্চারা সামলাতে পারবে?
ঝিনুকের চিন্তাটা বিনয়কে উতলা করে রেখেছিল। তার ফাঁকে ঝাঁকে উদ্বাস্তুদের নিয়ে এই সব ভাবনা তার মাথায় ঢুকে পড়ছে।
বিভাস আর নিরঞ্জনের কর্মকাণ্ডে লেশমাত্র ত্রুটি নেই। হাঁকডাক করে তারা উদ্বাস্তুদের লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। শরণার্থীদের মাথায় বা হাতে তাদের লটবহর। নানা বয়সের বিবাহিত মেয়েদের কোলে কাখে ছোট ছোট দুধের শিশু, সেই সঙ্গে কাধ থেকে ঝুলছে ময়লা চট কি মোট কাপড়ের ঝুলি। সেগুলোর ভেতর টুকিটাকি নানা জিনিসপত্র।
বিভাস টিনের চোঙা মুখে লাগিয়ে উদ্বাস্তুদের উদ্দেশে সমানে চিৎকার করে যাচ্ছিল, ভাইয়েরা বইনেরা মায়েরা, কয়টা দিন। আপনাগো উপুর দিয়া মেলা (অনেক) তাফাল গ্যাচে। আইজ আর আপনাগো নয়া বসতে নিয়া যামু না। রাইতখন পোর্ট ব্লেয়ারে কাটাইয়া কাইল সকালে রওনা দিবেন। সে একনাগাড়ে বলতে লাগল, ‘অহন আমরা যামু এবারডিন বাজারের সুমখে। হেইহানে আপনেগো থাকনের ব্যবস্থা করা আছে। জাগাখান (জায়গা) বেশি। দূরে না। হাইটাই যাওন যাইব। আহেন, আমাগো লগে আহেন-’
ভালো ছিল
এর আগে– অনেক দিন আগে কেয়া পাতার নৌকা পড়ার সৌভাগ্য হয়েছিল, তখন বয়স ছিল কুড়ি একুশ, এখন বাষট্টি , ঠিক তেমনই আগ্রহ নিয়ে উপন্যাসটি শেষ করলাম। কম্পিউটারাইজড প্রিন্টের জন্য কিছু মুদ্রন প্রমাদ থাকলেও ভীষন ভালো লাগলো। প্রফুল্ল রায়ের লেখা খুব ভালো লাগে। তবে শেষটা জানা গেল না।পরনতি কি হল জানার জন্য মনটা উতলা হয়ে থাকলো।