এই যে এতগুলো সর্বহারানো মানুষ ঘোর অনিচ্ছায় সমুদ্র পাড়ি দিয়ে চলে এসেছে সেজন্য বিনয়ও কম দায়ী নয়। সে হলধরদের বুঝিয়েছে, ত্রাণশিবিরে যৎসামান্য সরকারি খয়রাতের ওপর নির্ভর করে আমেরিকান টমিদের ফেলে যাওয়া ব্যারাকের ঘুপচি কামরায় কামরায় কষ্টে, গ্লানিতে বাকি জীবন কাটানো অসম্ভব। তা ছাড়া তাদের ছেলেমেয়েরা আছে। তাদের ভবিষ্যৎ আছে। এই সন্তান সন্ততিদের কথাও তো ভাবতে হবে। তারা কি চিরকাল ত্রাণশিবিরে নিজেদের গায়ে ‘রিফিউজি’ তকমা লাগিয়ে কাটিয়ে দেবে? আন্দামানে গেলে উর্বর জমি মিলবে। ধান বোনো, আনাজের চাষ করো, শস্যের লাবণ্যে ভরে যাবে মাঠ। সমুদ্রে আছে অফুরন্ত মাছ, জঙ্গলে হরিণ। একটু খাটলে আমৃত্যু খাদ্যের অভাব হবে না। তাছাড়া তাদের সাহায্য করার জন্য রয়েছে নানারকম সরকারি সাহায্য, অনুদান।
বিনয়ের ধারণা ছিল, পোর্টব্লেয়ার শহরের আশেপাশে উদ্বাস্তুদের গ্রাম বসানো হচ্ছে। কিন্তু এখানে পৌঁছনোর পর অন্যরকম শোনা যাচ্ছে। যদি শরণার্থীরা বিপন্ন হয়ে পড়ে তাদের শেষ অবলম্বনটুকু ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। হঠাৎ মনে পড়ল, এর আগে চার-পাঁচ খেপে কয়েক হাজার শরণার্থীকে এখানে আনা হয়েছে। তারা কোথায় আছে, কেমন আছে, জানা নেই। যদি ভালো না থাকে, নিশ্চয়ই অভিযোগ শোনা যেত। পরক্ষণে খেয়াল হল, ওটা তো কলকাতা শহর নয় যে ভালো বা মন্দ সমস্ত খবর লহমায় লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে পৌঁছে যাবে। পৃথিবীর জনারণ্য থেকে বহুদুরে দুর্গম জঙ্গলের খাঁজের ভেতর উদ্বাস্তুদের আদৌ কোনও সমস্যা হচ্ছে কিনা, হলে কী ধরনের সমস্যা–তা সহজে জানার উপায় নেই। বিনয়ের মনে কিছুটা ধন্দ দেখা দিয়েই চকিতে মিলিয়ে গেল। ছিন্নমূল মানুষগুলো তেমন কোনও সংকটে যদি পড়েই থাকে, সরকারি দপ্তর তার মতো একজন সাংবাদিককে নিশ্চয়ই আন্দামনে পুনর্বাসনের কাজকর্ম দেখাতে নিয়ে যেত না। কেননা, এখান থেকে সে যে প্রতিবেদন লিখে পাঠাবে, তাতে মেনল্যান্ডে সব জানাজানি হয়ে যাবে। পশ্চিমবঙ্গে এর মধ্যেই উদ্বাস্তুদের নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো টানাহ্যাঁচড়া শুরু করে দিয়েছে। রোজই কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় আর পার্কগুলোতে মিছিল, মিটিং, স্লোগান। আন্দামানে এসে শরণার্থীদের দুর্গতির শেষ নেই, সত্যিই যদি তেমনটা হয়ে থাকে আর তা জানাজানি হয়ে যায়, কলকাতায় আগুন জ্বলে যাবে। ত্রাণ শিবিরগুলোতে বা শিয়ালদায় বছরের পর বছর যারা পড়ে আছে তাদের একজনকেও আর আন্দামানের জাহাজে তোলা সম্ভব হবে না। এখানকার পুনর্বাসন প্রক্রিয়া পুরোপুরি বানচাল হয়ে যাবে।
হলধররা একদৃষ্টে বিনয়ের দিকে তাকিয়ে ছিল। বিনয় বলল, আপনাদের মতো আমিও শুনেছি জারোয়ারা তাদের কাছাকাছি এলাকায় নতুন কারওকে দেখলে তির ছোড়ে। কিন্তু কলকাতা থেকে নিয়ে এসে আপনাদের বিপদের মধ্যে ফেলে দেওয়া হবে, তা তো আর হয় না। সরকার জারোয়াদের ঠেকাবার জন্য কিছু একটা ব্যবস্থা কি আর করেনি?
ঘুরিয়ে একরকম মিথ্যেই বলতে হল। উদ্বাস্তুদের নিরাপত্তার জন্য কোনওরকম বন্দোবস্ত করা হয়েছে কিনা, বিনয়ের জানা নেই। কিন্তু সত্যিটা বললে হলধররা আরও ভয় পেয়ে যাবে। পোর্ট ব্লেয়ারে নেমে হয়তো এমন বেঁকে বসবে যে জঙ্গলে যেখানে তাদের জন্য জমি ঠিক করে রাখা আছে তাদের সেখানে নিয়ে যাওয়া যাবে না। তুমুল হইচই বাধিয়ে একটা বিশ্রী পরিস্থিতি তৈরি করে ফেলবে।
মাখন রুদ্রপাল চতুর লোক। হলধরের পাশ থেকে সে বলে ওঠে, মনে লয় (হয়), জারোগো ব্যাপারে সরকার কী ব্যাবোস্তা করছে, আপনে পুরাটা জানেন না। ডেকের অন্য দিকে, বেশ খানিকটা দূরে, সেনসাহেব, মণ্ডলসাহেব, ডাক্তার চট্টরাজ, বিশ্বজিৎ রাহা এবং আরও কয়েকজন অফিসার কিছু আলোচনা করছিলেন। তাদের দিকে আঙুল বাড়িয়ে দিল মাখন। উই ছারেগো (স্যারদের) আমাগো কথা ইট্ট বুজাইয়া কইয়েন ছুটোবাবু। দ্যাশ ছাইড়া আহনের পর কত কষ্ট যে পাইছি হের (তার) লিখাজুখা (লেখাজোখা) নাই। আন্ধারমান দ্বীপি বড় আশা লইয়া আইছি। ওনারা য্যান দ্যাহেন আমাগো এইহানে মরতে না হয়।
মাখন সার সত্যটা এর মধ্যেই বুঝে গেছে। বিশ্বজিৎ রাহা, মণ্ডলসাহেব, সেনসাহেবরাই তাদের আসল রক্ষাকর্তা। বিনয়ের বেশ মজাই লাগে। বলল, আপনারাই গিয়ে ওঁদের বলুন না
হলধরের হয়তো মনে হল, বিনয় বিরক্ত হয়েছে। মাখন ফের কী বলতে যাচ্ছিল, গলার স্বর চড়িয়ে তাকে থামিয়ে দিল।–‘তুমি চুপ যাও। কারে কী কইতে হয় জানো না। ছুটোবাবু যা ভালা বুঝবেন হেয়া (তা) করবেন।’ বিনয়কে বলল, ‘আপনেই আমাগো বলভরসা। মাখনার কথায় কিছু মনে কইরেন না।’
বিনয় একটু হাসল। সরকারি অফিসারদের কাছে তাদের হয়ে দরবার করার জন্য মাখন যে তাকে ধরেছে তাতে হলধর খুবই অসন্তুষ্ট এবং বিব্রতও। বিনয়ের ওপর তার অগাধ আস্থা। যা যা করলে এই অজানা দ্বীপপুঞ্জে তাদের নতুন জীবন হবে অবাধ, ভয়শূন্য আর নিশ্চিন্ত, রাজদিয়ার হেমকর্তার নাতি তাই করবে। সাউকারি করে মাখনের পরামর্শ দেবার দরকার নেই।
হলধর বলল, ‘একহান কথা জিগামু ছুটোবাবু?’ আস্তে মাথা নাড়ে বিনয়।-–‘হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।’
দূরে বিশ্বজিৎ রাহাকে দেখিয়ে হলধর বলল, ‘তেনি তহন (তিনি তখন) পুট বিলাসে (পোর্ট ব্লেয়ার) তেনার বাড়ি আপনেরে থাকনের কথা কইলেন।’
ভালো ছিল
এর আগে– অনেক দিন আগে কেয়া পাতার নৌকা পড়ার সৌভাগ্য হয়েছিল, তখন বয়স ছিল কুড়ি একুশ, এখন বাষট্টি , ঠিক তেমনই আগ্রহ নিয়ে উপন্যাসটি শেষ করলাম। কম্পিউটারাইজড প্রিন্টের জন্য কিছু মুদ্রন প্রমাদ থাকলেও ভীষন ভালো লাগলো। প্রফুল্ল রায়ের লেখা খুব ভালো লাগে। তবে শেষটা জানা গেল না।পরনতি কি হল জানার জন্য মনটা উতলা হয়ে থাকলো।